২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

স্বাস্থ্যসেবার তথ্য কেন তাঁরা লুকিয়ে রাখতে চান

৯ জুলাই পত্রিকায় স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে দুটি ভিন্নমুখী খবর ও বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। একটি হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাকালে কত বেশি কাজ করেছে, বিজ্ঞাপন আকারে তার বয়ান। আরেকটি ঢাকা জেলার সিভিল সার্জনের নির্দেশ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনে করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ ‘আন্তরিক ও কঠোরভাবে’ পালনের জন্য দেশবাসীর কাছে আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে তাদের এ বয়ান আবেদনের মধ্যে সীমিত ছিল না। সংসদের ভেতরে ও বাইরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে যেসব ‘ভুল’ তথ্য ও ঢালাও সমালোচনা করা হয়েছে, তার সমুচিত জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে করোনাকালে তারা কী কী কাজ করেছে, আরও কী কী করার পরিকল্পনা আছে, তারও বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে এতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনে বলা হয়: গত কয়েক মাসে তারা ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা কিনেছে, ৬৫ লাখ ৬ হাজার ৭৮১ জনের কোভিড পরীক্ষা করেছে, বিভিন্ন হাসপাতালে ১ লাখ করোনা রোগীর চিকিৎসা হয়েছে, সারা দেশে ১০০টি অক্সিজেন সেন্ট্রাল লাইন স্থাপন, ১৭টি ল্যাব স্থাপন করেছে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বাংলাদেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসাবে পাক্কা পাঁচ মাস হয়েছে। এই সময়ে ১ কোটি ডোজ টিকা দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আত্মসন্তুষ্টির শেষ নেই। আর ভারতে এক দিনেই ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়েছে। আমাদের করোনার পরীক্ষার অবস্থাও নাজুক। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তার খুব কমই পরীক্ষা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি এলাকায় জরিপ করে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এর অর্থ এদের কোনো না কোনো সময় করোনা হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা করা হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, করোনাকালে তারা ৪০ হাজার লোকবল নিয়োগ দিয়েছে। এই ৪০ হাজার লোকবলের মধ্যে ২১ হাজারই টিকার স্বেচ্ছাসেবক। ১৪ হাজার নার্স ও ৪ হাজার চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু তারা বলেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কত হাজার পদ এখনো খালি আছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরের খবরে বলা হয়, ৪২ হাজার পদ খালি আছে। গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সমকাল প্রতিবেদন করেছিল, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০ হাজার ৩৮৩টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ৮ হাজার ৫৯টি নন-মেডিকেল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। শুক্রবার ইত্তেফাক-এর খবরে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের ৫০ শয্যার সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মাত্র তিনজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে।

কেবল লোকবল নয়, হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির ঘাটতিও আছে। গত ১ এপ্রিল প্রথম আলোর খবর ছিল, করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫টিতেই নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন ও উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা বাড়াতেও বলা হয়েছিল। ১০ মাসেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি।

উল্লেখ্য, শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেশন দরকার হয়।

শুক্রবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘আইসিউ জোটেনি, চলে গেলেন রূপা’ শিরোনামের খবরটি পড়ে মন বিষণ্ন হলো। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন রূপা খাতুন নামের এক নারী। এক মাসের বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা গুরুতর। কিন্তু আইসিউতে যেতে পারছিলেন না শয্যাসংকটের কারণে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা আছে মাত্র ২০টি। অপেক্ষমাণদের তালিকায় রূপার অবস্থান ছিল ৯৫। কিন্তু আইসিইউতে নেওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে কর্তাব্যক্তিরা বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেছেন, তাঁরা কি জানেন আইসিইউর শয্যা না থাকায় আমরা কত রূপাকে হারিয়েছি? স্বাস্থ্যসেবা তো পরিসংখ্যান নয়। স্বাস্থ্যসেবা হলো মানুষকে বাঁচানো।

করোনা মহামারি চলাকালে তথ্য গোপন করতে বলার এ নির্দেশ কেবল তথ্য অধিকার আইনের পরিপন্থী নয়, মানবতাবিরোধীও।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের মৌলিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহে অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ঘাটতি আছে। সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসায় অনেক জেলায় আইসিউ নেই। এসবের ফলে রোগীর মৃত্যু বাড়ছে। (প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০২১)

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাফল্যের তথ্য জনগণকে জানাচ্ছে, তখনই ঢাকা জেলার হাসপাতালগুলোর করোনা রোগীদের তথ্য গণমাধ্যমকে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মাঈনুল আহসান। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) ঢাকা জেলার হাসপাতাল, জেলার সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, সব ধরনের মাতৃসদন কেন্দ্র, হেলথ ক্লিনিকসহ এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল অফিসারদের এ নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঢাকা জেলার হাসপাতালগুলোতে বিরাজমান কোভিড-১৯ মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে সিভিল সার্জন ছাড়া অন্য কাউকে টিভি চ্যানেল কিংবা কোনো প্রকার প্রিন্ট মিডিয়ার কাছে স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক কর্মকাণ্ড অথবা রোগ ও রোগীদের সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য আদান-প্রদান বা মন্তব্য না করার অনুরোধ করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যক্তিদের রোগীর ছবি তোলা, ভিডিও করা অথবা সাক্ষাৎকার ধারণ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের শামিল। কোনো তথ্য-উপাত্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে ঢাকা সিভিল সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলো। (বাংলা ট্রিবিউন, ৯ জুলাই ২০২১)

করোনা মহামারি চলাকালে তথ্য গোপন করতে বলার এ নির্দেশ কেবল তথ্য অধিকার আইনের পরিপন্থী নয়, মানবতাবিরোধীও। মানুষ গণমাধ্যমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের হালনাগাদ তথ্য পেতে চায়, সিভিল সার্জনদের দপ্তরে দপ্তরে গিয়ে তাদের পক্ষ তথ্য সংগ্রহ সম্ভব নয়। আর ঢাকা সিভিল সার্জন কি না বলে দিলেন গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। কথা বলা বারণ। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি নন। তিনি যেভাবে তাঁর অধীনদের তথ্য না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তার ওপরে যাঁরা আছেন, তঁারাও তো অনুরূপ নির্দেশ দিয়ে বলতে পারেন, সিভিল সার্জন কোনো তথ্য দিতে পারবেন না। তথ্য পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কিংবা মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

এর অর্থ স্বাস্থ্যসেবার তথ্য থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা। সেই অধিকার সিভিল সার্জনকে কে দিয়েছে? এটি কি ঢাকার সিভিল সার্জন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিয়েছেন, না নির্দেশিত হয়ে, সেটাও জানা দরকার। গত বছর করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে যখন করোনা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে হযবরল অবস্থা চলছিল, তখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ রকম নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।

যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেকে ‘সফল ও বহির্বিশ্বে বিপুলভাবে প্রশংসিত’ দাবি করে, তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এত লুকোচুরি কেন? কেন তারা স্বাস্থ্যসেবার তথ্য লুকিয়ে রাখতে চায়?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]