একলেসিয়া প্রাচীন গ্রিসে নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হিসেবে সুবিদিত। এই পদ্ধতিতে যোগ্য নাগরিকেরা নগর ও রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রণীত আইন সম্পর্কে চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার অধিকার রাখতেন। তাঁরা সংসদ সদস্যদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না; কিন্তু যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তবে এটি পুরোপুরি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি ছিল না। কারণ, সমাজের সব স্তরের মানুষের, যেমন: গ্রামের দরিদ্র মানুষ কিংবা নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাই একটি দেশের সব মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারভুক্ত বিষয়গুলোয়—স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি—একলেসিয়া পদ্ধতি হুবহু অনুসরণ করলে অর্থবহ ফলাফল নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একলেসিয়া পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে এই পদ্ধতিতে মতামত সংগ্রহের একটি সর্বজনীন উপায় হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আধুনিক এই সময়েও একলেসিয়া পদ্ধতি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে একটি সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি হতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি লক্ষণীয়; কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির প্রাদুর্ভাব এবং সাম্প্রতিক কালে ডেঙ্গু রোগ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চলমান দুর্বলতাগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য করণীয় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, মানসিক অসুস্থতা স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের জীবনে নীরবে আঘাত হেনে চলেছে। আরেকটি আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের পক্ষে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে রিপোর্ট করেছে। যদিও স্বাস্থ্য একটি সর্বজনীন ও মৌলিক অধিকার কিন্তু, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় সবার অভিজ্ঞতা সমান নয়। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ ন্যায্যতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা পায় না। এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৫ সালে এশিয়া-প্যাসিফিক অবজারভেটরি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি ও বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নসহ শহর ও পল্লী এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের অসম স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়টিকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওপরের আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি জনকল্যাণমুখী ও অংশগ্রহণমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। প্রথমত, একটি অধিকতর অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া কি আদৌ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থাকে সহায়তা করতে পারবে? দ্বিতীয়ত, অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব? তৃতীয়ত, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি কোনো অবস্থায় রয়েছে?
যেকোনো জননীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল অংশগ্রহণ সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, জনসম্পৃক্ততা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও সেবার ক্ষেত্রে অন্যায্য দূর করে। কেউ কেউ জনগণকে সম্পৃক্ত করে নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম ব্যয়বহুল বলে সমালোচনা করেন। যদিও জনসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে প্রণীত নীতির সুফল ও উপকারের তুলনায় ব্যয় যা হয় তা খুবই সামান্য। অতএব, একটি অধিকতর অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত স্বাস্থ্যনীতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বিপুলভাবে সহায়তা করতে পারে।
বাংলাদেশে জননীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব—এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝব, সেটা সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। দেশের নাগরিকেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াসহ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রমে যুক্ত হবেন। ফলে, প্রণীত নীতির সামাজিক প্রভাবও নিরূপণ করা যাবে। স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নাগরিকদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্পৃক্ত করা কঠিন হলে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে একটি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেখানে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
যেকোনো জননীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল অংশগ্রহণ সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, জনসম্পৃক্ততা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও সেবার ক্ষেত্রে অন্যায্য দূর করে।
বাংলাদেশে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের বিষয়টি বর্তমানে কোন অবস্থায় রয়েছে, এ–সংক্রান্ত তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি মূলত আমলাতন্ত্রের কার্যাধীন। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমে অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হলেও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। গবেষণাপত্রের লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম আতিকুল হক সংশ্লিষ্ট সরকারি, বেসরকারি ও নাগরিকদের সাক্ষাৎকার এবং তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তারা নীতিমালা প্রণয়ন করাকে কেবল তাঁদের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা বিদ্যমান নীতিমালা উন্নয়নে কোনোমতে কাজটি শেষ করে থাকেন।
এম আতিকুল হক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে জননীতি প্রণয়নে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা আমলাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ গঠনমূলক ও সর্বব্যাপী না হয়ে আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়েছে। সর্বোপরি, জননীতি প্রণয়ন কার্যক্রমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কারা সম্পৃক্ত হবেন, তার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকায় জনগণের অংশগ্রহণ মূলত শর্ত পূরণের জন্য করা হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক উদাহরণের আলোকে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক করা যেতে পারে? যেমন: থাইল্যান্ডে ন্যাশনাল হেলথ অ্যাসেম্বলি কার্যক্রমের মাধ্যমে সে দেশের সরকার, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের জন্য দরকারি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ওষুধ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, সুস্বাস্থ্যের জন্য সাইকেল চালনা, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারসংক্রান্ত বিষয়, সুস্বাস্থ্যের জন্য আবাসনসহ প্রায় ৮৫টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সম্পর্ক দ্বিমুখী হওয়া দরকার। নাগরিকদের জানা দরকার, তাঁরা কীভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন? বিগত দিনগুলোয় তাঁরা কীভাবে সংগঠিত হয়েছেন—এই আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে আগাতে পারেন। একলেসিয়ার মতো জনমত সংগ্রহ পদ্ধতিতে অর্থবহ মতামত দিতে তাঁরা কতটুকু প্রস্তুত? রাষ্ট্র জনগণের মতামত গ্রহণে কতটুকু প্রস্তুত? এবং সবশেষে যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবে চলে আসে—রাষ্ট্র ও নাগরিকেরা যদি একে অন্যের কথা শোনার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি কীভাবে হবে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে জনগণের ফলপ্রসূ অংশগ্রহণ ঘটানো সম্ভব হবে। ফলে, বাংলাদেশের জনগণ সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য স্বাস্থ্য অধিকার পাওয়ার পথ সুগম হবে।
শেগুফা হোসেন ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্ট, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ