গত বছরের মতো এবারও ১০০ কোটি টাকার গবেষণা বরাদ্দ নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের একটা ইতিবাচক দিক। উৎসমূলে ১০ শতাংশ ট্যাক্স এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাদ দিলে যদিও সেটি ৭৫ কোটি টাকা। তবে ব্যবহারোপযোগী অংশ আরও একটু কম হলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হবে। সেটা নির্ভর করছে এই ফান্ড ব্যবহারের উদ্দেশ্য, বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা, সর্বোপরি দেশে গবেষণার পরিবেশের ওপর।
সামগ্রিকভাবে মেডিকেলবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাবই এই পিছিয়ে থাকার বড় কারণ নয়। মূল সমস্যা হলো মেডিকেল প্রফেশনালদের মধ্যে গবেষণার সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ না থাকা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের মধ্যে গবেষণার আকর্ষণ ও সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তাই এই ফান্ড ব্যবহারের একটি মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাদের মধ্যে গবেষণার সক্ষমতা বাড়ানো। আর তার জন্য একাডেমিক গবেষণার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠদান ও গবেষণা করা হয়, সেখানে এই গবেষণা বরাদ্দের একটি বড় অংশ ব্যয় করা উচিত। এর জন্য তৈরি করতে হবে উপযুক্ত নীতিমালা।
যেহেতু একাডেমিক গবেষণার উৎকর্ষ পরিমাপের সবচেয়ে উত্তম মাপকাঠি হলো দেশি-বিদেশি স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশনা করা। তাই প্রকাশনাকেই একাডেমিক গবেষণার চূড়ান্ত প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য করতে হবে। তবে জার্নাল প্রকাশনা যেহেতু সময়সাপেক্ষ এবং নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, তাই ফান্ড প্রদান প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—গবেষণার উপকরণ খরচ এবং প্রকাশনার জন্য প্রণোদনা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, এক্সপেরিমেন্টের খরচ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের খরচ, রিএজেন্ট বা কেমিক্যাল ক্রয়ের খরচ, ল্যাবরেটরির সামগ্রী ক্রয়ের খরচসহ গবেষণা সম্পাদনের নানা রকম উপকরণ খরচ এবং জার্নাল প্রকাশনার জন্য সাবমিশন ফি ধাপে ধাপে প্রদানের ব্যবস্থা থাকা। আর প্রকাশনার পর গবেষক দলকে প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা। এ ক্ষেত্রে জার্নালের মান অনুযায়ী প্রণোদনার পরিমাণ ভিন্ন হবে। উল্লেখ্য, একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষণার সঠিক বিষয়বস্তু নির্ধারণের দায়িত্ব গবেষকদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। গবেষক দল গুরুত্ব অনুযায়ী বিষয়বস্তু নির্ধারণ করবে।
একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এবং পলিসি রিসার্চের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবে এবং তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গবেষণা বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য গবেষণার দ্বার উন্মোচনে সহায়ক হবে
গবেষণা ফান্ডের অন্য অংশ খরচ করতে হবে স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারণে যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন এবং এ খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য যেসব গবেষণা প্রয়োজন, তার ওপর। এ ক্ষেত্রে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমান যে ধারা চালু আছে, তাতে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। দেশে এখন অজস্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কনসালটিং ফার্ম রয়েছে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই নামসর্বস্ব, যাদের কোনো স্থায়ী জনবল নেই। এগুলো মূলত ভাড়া করা পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করে। তাই টিকে থাকার জন্য একদিকে নানা রকম দুর্নীতির আশ্রয়ে কাজ বাগিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকে, অন্যদিকে ফাইন্যান্সিয়াল প্রপোজালের আকার ছোট রাখে। কস্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি বেজড সিলেকশন প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় তারা টেকনিক্যাল প্রপোজালে অনেক পিছিয়ে থেকেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়। আর এদের কাজ পাইয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জড়িত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টাও অনেক সময় চোখে পড়ে।
মোটকথা, একধরনের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নামসর্বস্ব গবেষণা হচ্ছে, যেসবের অধিকাংশই আবার লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি না করেও গবেষণাকর্ম সম্পাদনের নজিরও বিদ্যমান। তাই এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন গবেষণার বিষয় নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে গবেষণা প্রস্তাবে কারা অংশগ্রহণ করতে পারবে, তা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। আবার গবেষণা প্রস্তাব মূল্যায়নের টেকনিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল মার্ক বণ্টনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ৬০ ভাগ নিজস্ব বিশেষজ্ঞ আছে, শুধু তাদের আবেদন করার সুযোগ দিলে সঠিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের পথ অনেকটাই প্রশস্ত হবে। অন্যদিকে ফাইন্যান্সিয়াল প্রপোজাল মূল্যায়নের মার্ক ২০ থেকে ১০-এ নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে টেকনিক্যাল প্রপোজালকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায়। শুধু এর ওপর ভিত্তি করেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। যেহেতু প্রতিটি গবেষণা প্রকল্পের পূর্বনির্ধারিত একটি বাজেট থাকে, তাই বাজেট-সংক্রান্ত তথ্য বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন ফাইন্যান্সিয়াল প্রপোজালের জন্য কোনো মার্ক থাকবে না, তাই বাজেট জানার জন্য এবং জানানোর জন্য যেসব দুর্নীতি হয়, তাদের পথ রুদ্ধ হবে। আর যেখানে নির্দিষ্ট বাজেট থাকে না, সেখানে টেকনিক্যাল প্রপোজালের মেরিট অনুযায়ী বাজেট সমন্বয় করা যেতে পারে। সর্বোপরি গবেষণার ফলাফলকে নীতিনির্ধারণে কাজে লাগানো হলে গবেষণার মান বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হবে।
আমরা ইতিমধ্যে জানি, গত অর্থবছরের বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকার ফান্ড থেকে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে। ১১টি ব্রড ইস্যুর ওপর গবেষণা প্রস্তাব জমা দেওয়া যাবে। এ গবেষণা প্রস্তাব মূল্যায়ন ও নির্বাচনের জন্য উচ্চপর্যায়ের দুটো মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমান নীতিমালার আলোকে এই ফান্ডের সঠিক ব্যবস্থাপনা কতটুকু কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এ ক্ষেত্রেও ফান্ড অব্যবস্থাপনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই ফান্ড ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন, গবেষণাকর্মের বিভিন্ন ধাপ দেখভাল এবং মূল্যায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এই দৌড়ে এগিয়ে থাকলেও নিজস্ব জনবলকাঠামোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সক্রিয়তা ও গতিশীলতার অভাব তো আছেই। পরবর্তী ধাপে থাকা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটেও সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তবে সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গতি আনতে পারলে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও ফান্ড ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এবং পলিসি রিসার্চের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবে এবং তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গবেষণা বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য গবেষণার দ্বার উন্মোচনে সহায়ক হবে।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়