লেখাটি যখন প্রথম আলোর সম্মানিত পাঠকের কাছে পৌঁছাবে তার আগেই তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে দুটি সহি বার্তা পেয়ে যাবেন। টিভি চ্যানেলগুলোতে দুই দলের বাকপটু নেতাদের সচিত্র বক্তৃতা-বিবৃতি ফলাও করে প্রচারিত হবে।
তবে বক্তৃতা-বিবৃতির সারমর্ম ভিন্ন হলেও লক্ষ্যবস্তু অভিন্ন। তাঁরা যা-ই করুন না কেন জনগণের কাঁধে বন্দুক রেখে করবেন। সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালনের জন্য বিএনপির নেতারা দেশবাসীকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা হরতাল প্রত্যাখ্যান করায় জনগণকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। তাঁরা জোর গলায় প্রচার করবেন, ২০-দলীয় জোটের হরতাল জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশের কোথাও হরতাল পালিত হয়নি এবং জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বহু বছর ধরেই এই স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকতার দোলাচলে দুলছে। আওয়ামী লীগের কাছে যেটি স্বাভাবিক, বিএনপির কাছে সেটি অস্বাভাবিক। আবার বিএনপির কাছে যেটি স্বাভাবিক, আওয়ামী লীগের কাছে সেটি অস্বাভাবিক। কিন্তু আমজনগণের কাছে দুই দলের আচরণই যে অস্বাভাবিক তা নেতারা স্বীকার করেন না।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে জনগণকে ঠেলতে ঠেলতে এমন চিপায় নিয়ে গেছে তাতে তাদের ধন্যবাদ বা অভিনন্দন গ্রহণের সুযোগ নেই। অথচ দল দুটি সবকিছুই করছে এই আমজনতার নামে।
হরতাল ডেকে বিএনপির নেতারা যেহেতু ঘরে বসে ছিলেন কিংবা নয়া পল্টনের অফিসে বসে রুটিন বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, সেহেতু হরতাল নিয়ে তঁাদের বক্তব্যকে তেমন আমলে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ নিজেকে গণতন্ত্রের একমাত্র কান্ডারি দাবি করছে, সেহেতু তার দাবি অগ্রাহ্য করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হরতালের দিনে সড়কে-মহাসড়কে মিছিল-সমাবেশ করে দেশবাসীকে জানাতে চাইছেন যে সবকিছু স্বাভাবিক। সবকিছু স্বাভাবিক আছে বলেই তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করছেন, প্রতিপক্ষকে যেখানে পাচ্ছেন প্রতিহত করছেন।
আওয়ামী লীগের এই স্বাভাবিক কাজের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক চিত্র পাওয়া গেছে।
১. সোমবার হরতালের কারণে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এর মধ্যে সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে, তেমনি আছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের মালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। অর্থাৎ তাঁরা প্রথমেই হরতালের অস্বাভাবিকতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপর আসি পরিবহন খাতে। আওয়ামী লীগ, ছা্ত্রলীগ, যুবলীগের নেতারাও পুলিশ প্রহরা ছাড়া তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িটি রাস্তায় বের করেননি। যেসব নেতার পরিবহন ব্যবসা আছে, তাঁরাও গতকাল দূরপাল্লার বাস রাস্তায় নামাননি।
জনগণের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির বয়স যদি ৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে হয়, তাদের সংখ্যা আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কোটি। এই সাড়ে পাঁচ কোটির মধ্যে অন্তত দুই–তৃতীয়াংশ কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। যদি গতকাল কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না হয়ে থাকে তাহলে কম–বেশি চার কোটি শিক্ষার্থীর ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল।
ক্ষমতাসীনদের দাবি অনুযায়ী, এই স্বাভাবিক দিবসে আরও যেসব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, তার একটি অসমাপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
১. নোয়াখালীতে পিকেটারদের ইটের আঘাতে শামসুন্নাহার নামের একজন শিক্ষিকা নিহত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ঢাকার তাওহীদ ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষিকা।
২. ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি এবং বাইরে থেকেও ঢাকায় আসেনি। কলকাতা থেকে সকালে এসে বেনাপোলে অনেক যাত্রী আটকা পড়েছেন। হরতালের কারণে গতকাল তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। এই যাত্রীদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিল।
৩. দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে যাত্রীরা যেমন বাইরে যেতে পারেননি, তেমনি বাইরের যাত্রীরাও ঢাকায় আসতে পারেননি।
৪. রাজশাহীতে ভাঙচুর ও ছাত্র–পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সিলেটে ছাত্রদলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আগামীকালও সেখানে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে।
ঝালকাঠি জেলার নলছিটিতে বাসে আগুন দিয়েছে হরতাল পালনকারীরা। হরতালের আগের সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনে বাসে আগুন দিয়েছে এবং সেগুনবাগিচায় ককটেল নিক্ষেপ করেছে পিকেটাররা, ধোলাইখালে শিবির মিছিল বের করে রাস্তায় আগুন দিয়েছে। পল্লবীতে গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের গুলিতে একজন আহত হয়েছে। মিরপুরে অটোরিকশায় আগুন দেওয়া হলে দুই সন্তানসহ মা অগ্নিদগ্ধ হন।
আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষায় ২০ দলের ডাকা হরতালে যেহেতু জনগণ সাড়া দেয়নি, সেহেতু হরতালের দায় তাদের ওপর চাপানো যাবে না। কিন্তু যেই দলের নেতারা বলছেন, জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই দলের নেতারা এসব অঘটনের দায় কীভাবে এড়াবেন?
দয়া করে তাঁরা কি বলবেন, জনজীবন স্বাভাবিক থাকা হরতালে দেশের ও জনগণের অস্বাভাবিক ক্ষতির পরিমাণটি কত?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]