স্বাধীনতার ৫০ বছরে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী, প্রথম আলোর সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমার অনুভূতিটা ছিল এই রকমের যে আমরা একটি মারাত্মক মরণব্যাধি থেকে মুক্ত হলাম। পরে প্রতিটি বছরে জিজ্ঞাসা জেগেছে, রোগ থেকে তো মুক্ত হলাম, কিন্তু তাই বলে কি সুস্থ হয়েছি? সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে মনে হচ্ছে, আমরা পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।’ [প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি]
মরণব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়ে কেউ যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হয়, দুর্বল অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার মধ্যে গৌরব নেই। এক প্রজন্মের নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, পরবর্তী প্রজন্মগুলোর অন্য রকম দায়িত্ব। সে দায়িত্ব যদি তারা যথাযথভাবে পালন না করে, জাতি সুস্থ ও সাবলীল হয়ে উঠতে পারে না। নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও মুক্তচিন্তার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, তেমনি একাংশের মধ্যে পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রফেসর চৌধুরী বলেন:
‘বাস্তব সত্যটা হলো, মানুষ ভাগ হয়ে গেছে। অনেকেই হতাশ। হতাশা থেকে আসে আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণকারীরা হয় অবসাদে পড়ে ও অন্ধকারের দিকে ছোটে, নয়তো নানা ধরনের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। সহিংসতা দেখা দেয়। সামাজিকভাবে সংস্কৃতির চর্চা নেই। আলোচনা নেই। বিতর্ক দেখা যায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে খর্ব হয়ে আসছে। প্রকাশের সুযোগ না থাকলে চিন্তাশক্তি বিকশিত হয় না।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আংশিক সঠিক—পুরোপুরি নয়। কারণ, বাংলাদেশে কারও কারও মনে যা আসে, তা-ই মুখ দিয়ে বলার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে, মননশীল মুক্তচিন্তা প্রকাশের অধিকার সবার নেই। বলতে গেলে ৯৯ শতাংশই সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। ঝুঁকি নিয়ে যদি কেউ তাঁর সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, তাঁর ঘাড়ের ওপর ঝুলন্ত রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ।
রাজনৈতিক নেতারা গণতান্ত্রিক পরিবেশেই হোক বা গণতন্ত্রহীন অবস্থায় হোক, জাতীয় স্বার্থে বহু রকম ভূমিকা পালন করেন। পার্লামেন্টের বিতর্কে জনস্বার্থে গুরুতর বিষয়ে অংশ নেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁরা যে বক্তব্য দেন, তার মধ্যেও শিক্ষণীয় থাকে অনেক বিষয়। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা। বিশেষ করে জনগণের যে অংশটির বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সৌভাগ্য হয়নি, তারা সভা-সমাবেশে নেতাদের বক্তৃতা থেকে বহু বিষয়ে অবগত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধে কার কী অবদান, সে প্রশ্নের মীমাংসা প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারই ১৯৭৩-এ করে গেছে। তার ওপর কলম চালানো, তাকে চ্যালেঞ্জ করা, অতি অশোভন।
জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণার সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেক সময় নেতারা সত্য-অসত্য মিশিয়ে নানা রকম অবান্তর কথা বলেন। সেসবকে ভোটাররা বিশেষ গুরুত্ব দেন না। কিন্তু স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থায় রাষ্ট্রের উঁচু অবস্থান থেকে জাতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যখন বক্তব্য দেন, তাকে অবহেলা করা যায় না।
ইতিহাসে যা ঘটে তা আর বদলানো যায় না, তবে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে নানাভাবে। এই মহামারির মধ্যেই ব্রিটেনে গান্ধীজির একটি মূর্তি সরানোর দাবি ওঠে। তখন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছিলেন, ‘হিস্টোরি ইজ অা কন্টিনিউয়িটি, উই ক্যান নট সেন্সর হিস্ট্রি—ইতিহাস হলো চলমানতা, তার কোনো অংশই ছেঁটে বাদ দিতে পারি না। গান্ধীজি কোন পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যাপারে কী বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার জন্য এখন আমরা তাঁকে অসম্মান করতে পারি না।
জিয়াউর রহমান একজন পেশাদার সৈনিক। একাত্তরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশের মানুষ তাঁকে চিনত না। তাঁর এমনই নিয়তি, ২৭ মার্চ থেকে তাঁর নাম দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে পরিচিতি পায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ হলেও শত্রুপক্ষ ছিল অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং চরিত্রে সেই সেনাবাহিনী ছিল হিংস্র। সেই শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য বেসামরিক গেরিলাযোদ্ধাদের সামরিক কর্মকর্তা ও জওয়ানদের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। আমাদের দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা সেই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার খেতাব প্রদান করে। সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং তাঁরা সবাই শাহাদত বরণ করেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীর উত্তম’ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরাও প্রায় সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, কেউবা সার্ভিসে ছিলেন, কেউবা অবসরপ্রাপ্ত। অনেকের সঙ্গে জিয়াউর রহমানও ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধে কার কী অবদান, সে প্রশ্নের মীমাংসা প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারই ১৯৭৩-এ করে গেছে। তার ওপর কলম চালানো, তাকে চ্যালেঞ্জ করা, অতি অশোভন।
জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শত্রু নয়। আমাদের দেশে নেতাদের কথাবার্তায় সৌজন্য তো নেই–ই, দায়িত্বজ্ঞানেরও ভীষণ অভাব। দু-তিন বছর আগে জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে চরম বে-আক্কেল ও বেয়াদবের মতো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ উক্তি করেন। তাঁকে সবাই ধিক্কার জানায়।
জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে ছিলেন—এই অভিযোগ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ পুনর্লিখনের প্রয়োজন হবে। দীর্ঘ ৯ মাস একজন ‘পাকিস্তানি চর’ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে কাজ করলেন, তারা কিছু টেরই পেল না।
অনেক মন্ত্রী প্রায়ই বক্তৃতায় বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত, তার প্রমাণ আছে। সেনাবাহিনীর ওপরের দিকের অনেকের জড়িত থাকা সম্ভব। অন্তত তাঁদের মদদ ও সায় না থাকলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও অভ্যুত্থান সফল হতো না। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। তাঁর বহু সিদ্ধান্ত সমালোচনা করা যায়।
আজকাল নেতারা কেউ কেউ বলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা নন। কিছুকাল যাবৎ এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে, তিনি ছিলেন ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ কথার অর্থ যে কতটা ক্ষতিকর, তা যাঁরা বলছেন তাঁরা ভেবে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধে জিয়া এবং অন্য কার কী ভূমিকা, তা প্রবাসী সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের না জানা খুব বড় ব্যর্থতা। জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে ছিলেন—এই অভিযোগ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ পুনর্লিখনের প্রয়োজন হবে। দীর্ঘ ৯ মাস একজন ‘পাকিস্তানি চর’ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে কাজ করলেন, তারা কিছু টেরই পেল না। স্বাধীনতার পর সেই চরকেই সেনাবাহিনীর শীর্ষ দুটি পদের একটি দেওয়া হয়। তিনি যে পাকিস্তানের এজেন্ট, সেটা কেউ জানতেই পারলেন না।
শত্রুকে নিন্দা করারও পরিমিত ভাষা আছে। সেটা অতিক্রম করলে লাভের চেয়ে লোকসান হয় বেশি। আওয়ামী লীগের সবাই অবশ্য এ কাজ করছেন না। জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন প্রত্যাহার করলে মৃত জিয়ার কোনো ক্ষতি নেই। তবে যেকোনো উদ্দেশ্যেই হোক, এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত হবে না, যা ভবিষ্যতের কোনো সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অপছন্দের বহু ব্যক্তিকে পদক ছিনিয়ে নিয়ে অপমান করতে পারে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতিকে করা উচিত একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ, তার পরিবর্তে যদি বিভক্তির চেষ্টা হয়, জাতীয় জীবনে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক