উন্নয়নের অনেক কথা এখন বলা হচ্ছে। কিন্তু এই উন্নয়ন কার জন্য? গাইবান্ধায় গিয়ে ওই সাঁওতাল কৃষককে কি কেউ জিজ্ঞেস করবেন তাঁর দিন কীভাবে চলে? তাঁদের পূর্বপুরুষের জমিজমার খবর কী? সাঁওতালের বাড়িঘর-গ্রাম প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেওয়ার পরও কেন দোষী ব্যক্তিদের কেউ গ্রেপ্তার হয় না? দেশ-বিদেশে এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরও কেন বিচার হয় না? নিজের জমি ফেরত চাইতে গিয়ে এখনো কেন সাঁওতালদের জীবন দিতে হয়? তবে কি দেশে এখনো ঔপনিবেশিক শাসন চলছে? তা না হলে পরাধীন ভারতবর্ষের মতো এখনো কেন সাঁওতালদের তির ছুড়তে হয়? যাঁরা উন্নয়নের এত কথা বলেন, তাঁরা দয়া করে ওই সাঁওতালকে প্রশ্ন করুন। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে প্রশ্ন করুন, কেন তবে তারা দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়।
প্রায় পাঁচ মাস হতে চলেছে, সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম অনেক উচ্চকণ্ঠ ছিল। আর কত সোচ্চার হলে রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসবে, জানি না। একটু আশার খবর হলো, মহামান্য আদালত সাঁওতালদের পাশে রয়েছেন। আমাকে প্রতিনিয়ত যে সাঁওতালরা ফোন করেন, তাঁদের বলি, আদালতের পানে তাকিয়ে আপনারা অন্তত স্বপ্ন দেখার অধিকার হারিয়ে ফেলবেন না। ওরা আমাদের স্বপ্ন দেখার অধিকারও কেড়ে নিতে চায়। আমরা পরাজিত হতে পারি না।
কথা ছিল ফাল্গুন মাসে বাহা উৎসব হবে সাঁওতালি গ্রামে। মাদল-ধামসা বাজিয়ে গান গাইবেন সাঁওতাল কৃষক। তরুণ-তরুণী নাচবেন কোমর জড়াজড়ি করে। ওঁদের জীবন হবে আনন্দময়। বাহা মানে ফুল। পৃথিবীর কটি জাতির ফুল উৎসব আছে? যে জাতি ফুল
উৎসব করে, সে জাতি মনে ও সংস্কৃতিতে কত উন্নত হতে পারে, একটু ভাবুন। আমি আশা করব, এই ফাল্গুনে না হলেও আগামী দিনে পূর্ণিমার রাতে এই দুঃখ-কষ্ট-অভাব-অনটনের মধ্যেও সাঁওতাল বন্ধুরা বাহা উৎসব উদ্যাপন করবে। আমাদের আনন্দ-হাসি-গান যেন কোনো অন্ধকার শক্তি কেড়ে নিতে না পারে। তরুণ সাঁওতালদের প্রতি আমার আবেদন, আমরা এভাবে হারতে পারি না। মাদলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হোক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সাঁওতালরা গরিব, কিন্তু তাদের আত্মমর্যাদা তুলনাহীন। যে দেশে ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে পদদলিত হয়ে মানুষ মারা যায়, সে দেশে সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। ওদের গ্রামে গিয়ে ত্রাণের গাড়ি নিয়ে সারা দিন অপেক্ষা করে বিস্মিত সরকারি কর্মকর্তা ফিরে গিয়েছিলেন।
এটি সত্যি যে ওদের সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নিঃস্ব হয়ে গেছে ওরা। হয়তো তাই বাহা উৎসব জমবে না অনেক সাঁওতালি গ্রামে। যেখানে ওদের থাকার ঘর নেই, কাজ নেই, খাবার নেই, সেখানে কী উৎসব হবে? আমরা দেখলাম, সাঁওতালদের জমি থেকে রাষ্ট্র-পুলিশ-প্রশাসন-রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শুধু উচ্ছেদই করেনি, বসতভিটা শুধু ছারখারই করেনি, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার পর ট্রাক্টর দিয়ে প্রকাশ্যে চাষ করে সব চিহ্ন মুছে দিয়েছে। যে দেশে এত বিভক্তি সবখানে, সেখানে সংখ্যালঘুদের জমি-সম্পদ কেড়ে নিতে এরা কত একতাবদ্ধ।
সাঁওতালদের ভাগ্য ভালো, প্রযুক্তির কল্যাণে ভিডিওর মাধ্যমে এই বর্বরোচিত ঘটনার খবর ছড়িয়ে গেছে দেশ-বিদেশে। শুরু থেকে উচ্চ আদালত মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। আমি আশায় বুক বাঁধতে চাই, মহামান্য আদালতের মাধ্যমে সাঁওতালরা জমি ফেরত পাবে।
অঘ্রান মাসে হামলা হয়েছিল, শীত পেরিয়ে এখন বসন্ত যায় যায়। কোনো প্রতিকার হলো না, পুনর্বাসন তো দূরের কথা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মহামান্য আদালত গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাঁওতালদের পুনর্বাসনে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারপরের খবর আমি জানি না। আদালতের ভূমিকায় শুরু থেকেই সাঁওতালরা আশাবাদী। এদিকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করা সাঁওতালদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আমার আশঙ্কা হয়, ধীরে ধীরে সমাধান হওয়ার আগেই মিডিয়া ঘটনাটি ভুলে যাবে। মিডিয়া হাল ছেড়ে দেবে। নাগরিক সমাজে ক্লান্তি নেমে আসবে। অথবা দেশে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হবে। মানুষ নতুন ইস্যু নিয়ে মেতে উঠবে। সাঁওতালদের দুর্দশার কথা সবাই ভুলে যাবে। একদিন সাঁওতাল জাতি মনের দুঃখে দেশান্তরি হবে অথবা হারিয়ে যাবে অন্য কোনো খানে।
পরাধীন ভারতবর্ষে তির ছুড়েছিল সাঁওতালরা। সিধু, কানু, তিলকা মাঝি বিদ্রোহ করেছিল। সাঁওতালরা একদিন জঙ্গলের জীবনে স্বাধীন ছিল। তখন সুখ ছিল। তখন দিকু, মহাজন, ঠিকাদার, তহশিলদার, গোরমেন (সরকার), বহিরাগত ঢোকেনি তাদের জীবনে। যেদিন সাঁওতালি জীবনে এদের প্রবেশ ঘটেছে, তখন থেকেই দুঃখ আর তাদের পিছু ছাড়েনি।
আমি মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম, রাষ্ট্র এত দানবিক ও হৃদয়হীন হতে পারে? আবার আশাবাদীও হয়েছিলাম সাঁওতালদের শক্তি ও সাহস দেখে। ওরা এখনো তির-ধনুকের গল্প বলে। হাসিমুখে লড়তে লড়তে জীবন দেয়। বীরের জাতি সাঁওতাল। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে তির ছুড়েছিল ওরা। কী নিষ্ঠুর নিয়তি, স্বাধীন দেশেও ওদের তির ছুড়তে হয়। আদালত ছাড়া ওদের পাশে এখন কেউ নেই। দেশে বড় বড় কথা বলার মানুষের অভাব নেই। এসব দেখে সাঁওতালদের দুঃখ ও হাহাকার বাড়ে।
মহুয়াগাছে ফুল ফোটার সময় এখন। এখন স্বপ্ন দেখার সময়। সাঁওতালদের স্বপ্ন দেখার অধিকার কেউ যেন কেড়ে নিতে না পারে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।