স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে

>
ফারুক চৌধুরী
ফারুক চৌধুরী
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরী আজ গত হলেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছিল তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের বালুকাবেলায়’। তাঁর বর্ণময় জীবনের একটি অংশ সে আত্মজীবনী থেকে প্রকাশ করা হলো।

১ জানুয়ারি ১৯৭২। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখনো বসার উপযোগী হয়নি। কিন্তু প্রয়োজন রয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে, জরুরি ভিত্তিতে, আমাদের আলাপ-আলোচনার। লোকের ভিড়ে তখন কোনো প্রকাশ্য স্থানে বসে আলাপ-আলোচনা ছিল অসম্ভব। তাই সেই সন্ধ্যায় আমার ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের পারিবারিক বাসভবন ‘সুরমা’য় হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জরুরি বৈঠক। সেই বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া উপস্থিত ছিলাম আমি, নিউইয়র্কের জাতিসংঘে আমাদের একসময়ের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এবং সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম আর ওসমানী। সেই সভায় একগাদা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, বিদেশ থেকে আমাদের অনেক কূটনীতিবিদের আশু ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বললেন, চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই তাঁর ভারত সফরের প্রস্তুতি নিতে। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার জন্য আন্তর্জাতিক মত গড়ে তোলাই হবে সেই সফরের প্রধান লক্ষ্য।

৪ জানুয়ারি ১৯৭২। নিজের জন্মদিনটির কথা আমার মনেই পড়েনি সেদিন অসাধারণ কর্মব্যস্ততায়। তিন-চার দিন পরিশ্রম করলাম আমরা সবাই সফরটির ‘ব্রিফ’ প্রস্তুতিতে। স্বাধীনতার সেই প্রারম্ভিক দিনগুলোতে তথ্য পাওয়া ছিল মুশকিল। কিন্তু তবু সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হলো ‘ব্রিফ’ অর্থাৎ সফরের উদ্দেশ্য এবং আলোচনা সম্বন্ধে তথ্য ও খসড়া নির্দেশনা। পরিকল্পনা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর আসবাবপত্রবিহীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের তিন-চারজনের ওপর বর্তেছিল সেই দায়িত্ব।
৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ ব্রিফ তৈরি শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গেলাম অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে—সফরের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে তাঁর অনুমোদন এবং নির্দেশনা লাভের জন্য। ব্রিফটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পড়লেন তিনি। সেদিন লক্ষ করেছিলাম, সমস্যার গভীরে তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ এবং অতিশয় প্রাঞ্জল, সুবোধ্য তাঁর বাচনভঙ্গি।
৫ জানুয়ারি ১৯৭২-এ ফুল কোঁচা দেওয়া শান্তিপুরী ধুতি আর মিহি সুতির পাঞ্জাবি পরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় ছিলেন আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন ব্যক্তি। কলকাতায় আমাদের কিছুক্ষণ অবস্থানের পর দিল্লির জন্য প্লেন বদল। দিল্লির প্লেনে উঠে দেখি সিদ্ধার্থশংকর রায়ও আমাদের সহযাত্রী। দিল্লির পথেই তাঁর সঙ্গে হলো প্রথম আলাপ—হৃদ্যতাপূর্ণ একটি নিবিড়তার সূচনায়।
দিল্লিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে যথেষ্ট লোকের ভিড়। অমায়িক, বিনয়ী, মিষ্টভাষী, সরদার শরণ সিং বিমানবন্দরে উপস্থিত তাঁর বাংলাদেশি সহকর্মীকে অভ্যর্থনা জানাতে। আরও মনে পড়ে, পূর্ব ইউরোপের বেশ কজন কূটনীতিবিদের কথা। যদিও তাঁদের কোনো দেশই তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। উপস্থিত ফরেন সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ তিনজন সহকর্মী আবদুল মোমেন, হোসেন আলী এবং দিল্লিতে আমাদের প্রতিনিধি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। জানুয়ারির দিল্লির শীতে রাত আটটাই যেন অনেক রাত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে সরদার শরণ সিং বিদায় নিলেন। অশোক হোটেলের ছয়তলায় আমাদের জন্য বরাদ্দ সব কামরা। কিছু পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে তাঁর স্যুইটে মিলিত হলাম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং আমি। সফরের কর্মসূচি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনায়। সামনে রয়েছে কর্মব্যস্ত দিনরাত্রি—আমাদের সমকালীন উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের নাটকীয় আত্মপ্রকাশে।
৬ জানুয়ারি ১৯৭২-এর অতি ভোরে দিল্লির অশোক হোটেলে চোখ মেললাম একটি পরিতৃপ্ত অনুভূতির অবগাহনে। মনে পড়ে, দিল্লিতে আমাদের অবস্থানের প্রথম সেই দিনে অশোক হোটেলের নিকটবর্তী জনবিরল রাজপথে প্রাতর্ভ্রমণকালের নিবিড় ভাবনার পালে লেগেছিল একটি প্রাণমাতানো হাওয়া—আমরা স্বাধীন, আমাদের দেশ সার্বভৌম। এই ভাবনাটি, বাংলাদেশি হিসেবে দেশান্তরে বসে প্রথম সেই পদক্ষেপগুলোতে, রোমাঞ্চকর কোনো হর্ষে কাঁপিয়ে তুলেছিল মন।
দিল্লির চাণক্যপুরীর অশোক হোটেলের আশপাশের জনপথগুলোর নাম সদিচ্ছাব্যঞ্জক। নীতিমার্গ, বিনয়মার্গ, ন্যায়মার্গ, সত্যমার্গ—প্রীতিপদ সব নামের সমারোহ। দিল্লির শীতকালীন কুয়াশাজাল ভেদ করে প্রাতর্ভ্রমণকারীর দিকে তাকিয়ে থাকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিরল, কিন্তু একান্ত কাম্য বিশেষণযুক্ত, মৌন নামফলকের সারি, একটি পথের শেষ আর অন্যটির শুরুতে।
সেই ভোরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের পতাকাশোভিত অ্যাম্বাসেডর গাড়িটি ছুটে চলল দিল্লির সুবৃহৎ সরণি, ‘রাজপথে’র এক প্রান্তে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ভবনে। অনেক রক্তাক্ত পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে এসেছে ‘রাজপথে’ চলমান শকটাগ্রের এই লাল-সবুজ পতাকা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিনের কার্যসূচির প্রথমেই রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার। তারপর কথাবার্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহের সঙ্গে। কাছেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার। আমরা, পাত্রমিত্ররা পার্শ্ববর্তী কক্ষে অপেক্ষারত। এই একান্ত সাক্ষাৎকারের শেষ ভাগে, দিল্লিতে আমাদের তদানীন্তন প্রতিনিধি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আর আমার তলব পড়ল প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে। এই প্রথমবার প্রবিষ্ট হলাম সেই কক্ষে, যেখানে পরবর্তী বছরগুলোতে কর্মসূত্রে কাটিয়েছি অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত। দ্রুত বিবর্তনশীল ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যথাক্রমে রাজীব গান্ধী, ভি পি সিং, চন্দ্রশেখর আর প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের সময়ে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারির সেই সাক্ষাৎকারের সময়ে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। একাত্তরের শারদীয় পূজামণ্ডপে মা দুর্গার সহস্র প্রতিমায় তাঁর অবয়বেরই ছাপ। বিজয়ের সাফল্যে আলোকে উদ্ভাসিত তার রাজনৈতিক রাজপথ। চাণক্যপুরীর পররাষ্ট্রনীতির পরিপূর্ণতার ‘সফল মার্গ’।
কিন্তু কী আশ্চর্য! ক্ষীণকায়া, মিষ্টভাষী আর পিতৃদত্ত তাঁর নামের মতোই প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী। সর্বপ্রকার সাহায্যদানে ভারতের সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্বন্ধে তিনি আশাবাদী। কামনা করলেন আমাদের সফরের সাফল্য।
সেদিন ভোরেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ভারতীয় দলের নেতা নীতি পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান, ডি পি ধর। আমাদের দলনেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বিভক্তিকরণ; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক অনুদলে। দ্বিপক্ষীয় সাহায্য সম্বন্ধে আমরা আমাদের মতামত ব্যক্ত করলাম, যাতে কালক্ষয় না করেই তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা শুরু করা যায়।
সেই অপরাহ্ণেই শরণ সিংহ প্রদত্ত ভোজসভা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মানে। একটি ঘটনা মনে পড়ে। জেনারেল মানেক শ ছিলেন নিমন্ত্রিত অতিথিদের একজন। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্মকালীন এই ভারতীয় সেনাপতির জনপ্রিয়তা তখন অসাধারণ। অশোক হোটেলের লবিতে তাঁর প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের কর্মকাণ্ড যেন থেমে গেল। বয়, বেয়ারা, রিসেপশনিস্ট, কর্মচারী, হোটেলে অবস্থানরত অতিথি—সবাই তাকিয়ে রইলেন যুদ্ধজয়ী এই সেনাপতির দিকে। এমনি তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু খাওয়ার সময়ে, তাঁর আসন, আমার যত দূর মনে পড়ে, টেবিল তিন অথবা চারে, আমার মতো সেই সময়ের নাতিজ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। কারণ, ভারতীয় অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন অনেক গণপ্রতিনিধি, যাঁদের রাষ্ট্রাচারজনিত স্থান সামরিক অথবা বেসামরিক কর্মকর্তাদের ওপর। বীরের সম্মানের সঙ্গে পদবির জ্যেষ্ঠতার নেই কোনো সম্পর্ক। আশির দশকে, আমি যখন দিল্লিতে হাইকমিশনার, দিল্লির লোকসভা আর রাজ্যসভায় যুগ্ম অধিবেশনে সদস্যদের দেখেছি দাঁড়িয়ে বিপুল করতালিতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রবেশরত ফিল্ড মার্শাল মানেক শ-কে চিরকৃতজ্ঞ জাতির সম্মান জানাতে। পারস্পরিক সম্মানেই হয় একটি পরিপূর্ণ সমাজের বিকাশ।
পরদিন, ৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকার বেশ কজন ভারতীয় মন্ত্রীর সঙ্গে। কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদ, অর্থমন্ত্রী চ্যবন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী, সেচমন্ত্রী কে এল রাও প্রমুখের সঙ্গে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমলা পর্যায়ের বৈঠক চলল দিনভর। ভারতীয় কূটনীতিবিদদের মধ্যে বৈঠকে ছিলেন কে পি এস মেনন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং মানি দীক্ষিত, বাংলাদেশে ভারতে প্রথম ডেপুটি কমিশনার এবং পরবর্তী সময়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব। ভারতীয় কূটনীতিবিদেরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান প্রশ্নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ধ্যানধারণা আমাদের কাছে ব্যক্ত করলেন। ব্যক্ত করলেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁদের অভিমত। তাঁদের প্রায় সবারই ধারণা যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ত্বরান্বিত করবে। তাঁদের উপস্থাপিত তথ্যাবলি প্রয়োজন ছিল আমাদের জানার। পররাষ্ট্রনীতির অঙ্গনে আমাদের তখন সবে হাঁটি-হাঁটি পা-পা।
বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপ্তিতে দুই দেশের আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। পরবর্তী ঘটনাবলির প্রাধান্যে স্মৃতিও তখন ঝাপসা। তবে ৯ জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষের একটি উদ্ধৃতি হয়তো বা আগ্রহোদ্দীপক। ইশতেহারটির ১৩ অনুচ্ছেদের বক্তব্য:
...দুই সরকারই পুনর্বার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে চান যে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশের মুক্তির উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগদানকারী ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে, বাংলাদেশ সরকার চাওয়ামাত্রই বাংলাদেশের সীমানা-অন্তর্বর্তী এলাকা থেকে অপসারণ করা হবে...।
বলা বাহুল্য যে বাংলাদেশ সরকারের এই ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে, ভারতীয় বাহিনী বাংলার মাটি ত্যাগ করে। পররাষ্ট্রনীতির রাজপথে আমাদের যাত্রারম্ভে।
দিল্লিতে ৮ জানুয়ারি ১৭৭২-এর সূর্যোদয় হলো প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতায়। সময়ের ব্যবধানে লন্ডনে তখন গভীর রাত। দুই মহাদেশ ভরা অন্ধকার চিরে পিআইএর বিশেষ বিমানটি তখন লন্ডনের পথে। দিল্লির চাণক্যপুরীর ছককাটা সুপ্রশস্ত জনপথ, তাদের সদিচ্ছাবাহী নামফলকের সারি আর সুবিন্যস্ত উদ্যানরাজি কুয়াশার আবরণ থেকে ধীরে ধীরে চোখ মেলল। জনবিরল জনপথে নির্ধারিত ক্রমিকতায় অবতীর্ণ হলো সাইকেল, স্কুটার, যাত্রীবাস আর সত্তরের দশকের দিল্লিতে আরোহীর বিত্ত, পদ অথবা দুয়েরই বার্তাবহ অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে উপবিষ্ট কর্মগামীদের ঝাঁক। আমরা, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরাও নির্ধারিত সময়ে তাঁদেরই দলে। আমাদের গন্তব্য সচিবালয়ের নর্থব্লকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক চলছে। অকস্মাৎ সম্মেলনকক্ষের দরজাটি সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত। চোখেমুখে তাঁর উত্তেজনার ছাপ।
এইমাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। খবর এসেছে তিনি ইতিমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।
ভেঙে গেল বৈঠক, সম্মেলনকক্ষটি ভেঙে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে। নিমেষে একটি সাধারণ দিন স্মৃতির মণিকোঠায় প্রবিষ্ট হলো অসাধারণের বেশে। উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোর স্মৃতিধারণ সুকঠিন। সেই মুহূর্তগুলোর ঘটনাপ্রবাহ অতি দ্রুত। তাদের বর্ণনা দুরূহ।
দুই দিনের উত্তেজনার ক্লান্তি শেষে অশোক হোটেলের কামরায় ৯ জানুয়ারির নীরব, নিস্তব্ধ, নিঝুম রাতটির কথা মনে আছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ঢাকা প্রত্যাবর্তন করবেন যথাসম্ভব শিগগিরই। শুধু রইবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচারপ্রধান হিসেবে আমি। দিল্লি থেকে বিশেষ বিমানে ঢাকা যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর সহগামী হব আমরা। আরও একটি সিদ্ধান্ত। পালাম বিমানবন্দরে, ১০ জানুয়ারি ভোরে পৌঁছেই উপস্থিত সাংবাদিক, সংবর্ধনাকারী তথা বহির্জগতের কাছে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশের সদ্য কারামুক্ত রাষ্ট্রপতি। সেই বক্তব্য প্রণয়নের ভার অর্পিত হলো আমার ওপর।
শুনেছি, রাষ্ট্রপরিচালনার শীর্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাষ্ট্রপ্রধান বড় একাকী। সেই একাকিত্বের অভিজ্ঞতা অবশ্য আমার নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ খসড়া প্রণয়নকারী আমলাও লাভ করেন একটি বিরল একাকিত্বের আস্বাদ। কাগজ-কলম হাতে খসড়া প্রণয়নকালে। তখন পৃথিবীর সব কোলাহল থেমে যায়। ৯ জানুয়ারিতে অশোক হোটেলের আমার কামরার সেই নিস্তব্ধ নিশীথের মতো।
কী লিখব তাঁর ভাষণে, যাঁর সঙ্গে জীবনেও ঘটেনি চাক্ষুষ পরিচয়। অথচ আমার সে সময়কার আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনার সুপ্তিভঙ্গের জন্য তিনিই প্রধানত দায়ী। কী লিখব তাঁর ভাষণে, যিনি সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে, বিজয়োত্তর উত্তেজনার প্রতিটি নিশ্বাসে, স্বাধীনতার দৃপ্ত পদক্ষেপে অযুত মানুষের মনোরাজ্যে বিস্তার করেছেন এক অভূতপূর্ব একচ্ছত্র আধিপত্য। কী লিখব তাঁর জয়যাত্রায়, যাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি রক্তাক্ত সাগরতীরে সূর্যোদয়ের মতো।
অশোক হোটেলের নিভৃতে আমার কক্ষে, ধীরে, অতি ধীরে, কলমের জড়তা গেল ভেঙে। তাঁর এই জয়যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। নয় মাসের ব্যবধানে দেশে ফিরছেন তিনি। সেই সময়টুকুতেই ‘আমার মানুষ শতাব্দী অতিক্রম করেছে’। তিনি ফিরছেন বিজয়কে শান্তি, প্রগতি আর উন্নতির পথে চালিত করতে। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই সান্ত্বনায় যে অবশেষে, অসত্যের ওপর সত্যের, উন্মাদনার ওপর মঙ্গলের হয়েছে জয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি গিরি, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দুপাশের জনতা। রাষ্ট্রপতি ভবন। ঝাপসা স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে পালাম বিমানবন্দর। সেই দিন বিমানবন্দরের হাজারো গণ্যমান্য মানুষের ভিড়েও স্মৃতিপটে শুধু ভেসে আসে গাঢ় ধূসর বর্ণের গলাবন্ধ স্যুট আর কালো ওভারকোট পরা নবীন দেশের এই রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি। শীতের হিমেল হাওয়ায় অসংখ্য সম্ভাষণ আর আলিঙ্গনে তাঁর ঘন কালো চুলও কিছুটা অবিন্যস্ত। স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি। তারপর বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন। তারপর ব্রাসব্যান্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ আর ‘জনগণ মন’ দুটি দেশকে উপহার দেওয়া বাংলার এক অমর কবির দুটি গানের রেশ সুমধুর। বিমানবন্দরে তাঁর আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি ভারত এবং ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন। ‘আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।’ তিনি স্মরণ করলেন তাঁর দেশবাসীকে। ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো, তারা কেঁদেছিল, আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী।’ অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখ। সেই অশ্রু ছিল ভালোবাসা, গর্ব আর আনন্দের।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার পর শীতের সেই প্রত্যুষের জনসভাও ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তাঁর পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তাঁর ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ...।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সংগীত। বক্তৃতা শেষে আবার মোটরমিছিলে জনসমুদ্র ভেদ করে পুষ্পতোরণসজ্জিত রাজপথে আমরা গেলাম নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে।
সেই সকালে আমার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধানের। আমার পাশে, সেই উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোতে, সর্বাঙ্গীণ সহায়তায় ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রাচারপ্রধান মাহবুব খান। তিনিই আমাকে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের পূর্বক্ষণে অবহিত করলেন আমাদের নির্ধারিত যাত্রাসূচি। দিল্লি থেকে আমরা সেই সকালেই যাব কলকাতা। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু অপরাহ্ণে একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা, যেখানে সেই অপরাহ্ণেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা। মাহবুব খান বললেন, দিল্লি থেকে আমরা সফর করব ব্রিটিশ কমেটে নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারি বিমান ‘রাজহংসে’। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের আগেই আমাদের মালামাল ‘রাজহংসে’ রাখা হলো। মাহবুব খান জানালেন যে বঙ্গবন্ধুবাহী ব্রিটিশ কমেটের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সহগামীদের মালামাল ‘রাজহংসে’ স্থানান্তরিত করা হবে। বললেন, সেই দায়িত্বটি হবে তাঁরই।
জনসভার পরপরই রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একান্ত বৈঠকে মিলিত হলেন। আমরা, পাত্রমিত্ররা, একটি পাশের সুসজ্জিত হল কামরায় উর্দি পরা রুপার ট্রে-ধারী বেয়ারাকুল দ্বারা গরম-গরম সমুচা, কাবাব আর ধূমায়িত চা-কফিতে আপ্যায়িত হচ্ছি। হঠাৎ আমার সহকর্মী মাহবুব খানের তলব পড়ল সেই কামরায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর বঙ্গবন্ধুর একান্ত বৈঠক চলছে। কিছুক্ষণ পরই ব্যস্তসমস্তভাবে বেরিয়ে এলেন মাহবুব খান। বললেন, ‘প্রিয় সহকর্মী আমার! সফরসূচি পাল্টে গেছে। সবকিছু পাল্টে গেছে। আপনারা আর কলকাতা যাচ্ছেন না। এখান থেকে সোজা ঢাকা। আর তা-ও আবার রাজহংসে নয়; ব্রিটিশ কমেটে।’ তারপর বললেন, তাতে তাঁর চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি এখনই বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমাদের মালামাল ‘রাজহংস’ থেকে আবার কমেটে রেখে দিতে আর ঢাকা ও কলকাতায় তিনি সেই মর্মে এখনই করবেন বার্তা প্রেরণ। আমার শুধু একটি দায়িত্বই রয়েছে। দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিশ্চিতভাবে অবগত হওয়া যে কমেট বিমানটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণ করতে সক্ষম হবে কি না। তাঁর সূত্র থেকে তিনি জেনেছেন যে তা সম্ভব; তবু সাবধানের মার নেই। আমারই তা সরাসরি জেনে নেওয়া উচিত হবে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে ছিল আমার বহুদিনের পরিচয়। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি যখন বেইজিংয়ে ব্রিটিশ দূতাবাসের কাউন্সিলর, আমি তখন সেখানে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। ৬ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মধ্যে আমার নাম খবরের কাগজে দেখে তিনি অশোক হোটেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। যদিও ব্রিটেন তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তি সম্বন্ধে ৭ ডিসেম্বর আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না, তবু টেরেন্স গারভি আমার সঙ্গে সেদিন আমার কামরায় দেখা করতে এসেছিলেন; আলোচনা করেছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর অবস্থা সম্পর্কে।
মাহবুব খানের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবেই আমি স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা প্রদান করলেন যে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে কমেট বিমানটির সম্পূর্ণ নিরাপদ অবতরণ সম্ভব।
প্লেনে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সিদ্ধান্ত বদলের কারণগুলো। শুনলাম কলকাতা যাত্রার সূচি পরিবর্তনের কারণ ছিল তিনটি। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে প্রথম সুযোগেই তাঁর দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি, তাহলে সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় হয়তো অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত, স্বাধীনতাসংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রাপথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে, যথার্থ হবে একটি বিশেষ সফরে কলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।
আর দিল্লি-ঢাকার এই যাত্রা, ভারতের রাষ্ট্রপতির বিমান ‘রাজহংসে’ নয় কেন?
বঙ্গবন্ধুর কথায়, ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছে, মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হতো না মোটেও।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্ণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধান হিসেবে অনুধাবন করেছিলাম যে আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষা লাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ। তার পরের স্মরণীয় দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরও।
যা-ই হোক, আশ্চর্য সেই প্রভাতে হঠাৎ ঢাকাগামী আমরা। প্লেনে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি।
‘এ কে?’ হঠাৎ অপরিচিত আমাকে দেখে অঙ্গুলিনির্দেশে তাঁর জিজ্ঞাসা।
আমার নাম উচ্চারণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, আপনার বিমানবন্দরের ভাষণটি এ-ই লিখেছে।
আমার মনের কথাগুলোই তো লিখেছে, বললেন বঙ্গবন্ধু।
আমার ইতিহাস-সচেতন মন হঠাৎ যেন দিল নাড়া। পকেটে রাখা তাঁর ভাষণটি এগিয়ে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে আপনার স্বাক্ষরিত ভাষণটি রাখতে চাই, সভয়ে বললাম।
‘নিশ্চয়ই। কলম দাও।’ বললেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ভাষণটি আজও রয়েছে আমার কাছে। তাঁর স্মৃতির একান্ত ব্যক্তিগত বাহক। আর রয়েছে ১৯৭২-এর আমার ডায়েরির ১০ জানুয়ারির পাতাটি। সেটাও সভয়ে এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ডায়েরির পাতাটি জুড়ে রয়েছে পুলকজাগানো সেই নামটি, শেখ মুজিব। স্পষ্ট, দৃপ্ত, চির অম্লান।
প্লেনের বাংলাদেশি যাত্রীরা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, সপরিবারে কামাল হোসেন, ইন্স্যুরেন্স জগতে সুপরিচিত বর্তমানে প্রয়াত মাওলা, সাংবাদিক আতাউস সামাদ আর আমি। প্লেনে তাঁর অনেক জিজ্ঞাসা। অনেক পরিচিতের সম্বন্ধে। নাম, পেশা, বয়স, স্থান, ঘটনা—কী আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি এই মানুষটির! তার কিছু কথা আমার মনে আছে, অনেক কথাই মনে নেই।
আমার ডায়েরির ১০ জানুয়ারির পাতাটি জুড়ে রয়েছে তাঁর স্বাক্ষর। ডায়েরির সেদিনের পাতায় তাই লেখার ছিল না কোনো স্থান। আর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী বেশ কটি দিন কর্মব্যস্ততায় ডায়েরি রাখার ছিল না সময়।
বেশির ভাগ সময়ই তাঁর প্লেনে কেটেছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে একান্ত আলাপ-আলোচনায়। মনে পড়ে, তাঁর সুপরিচিত আতাউস সামাদ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন সাংবাদিকের জড়তাহীনতায়। কামাল হোসেন ছিলেন আমার মতো, শ্রোতার দলে। মাওলাও।
দু-একটি কথা মনে পড়ে। দেশের মানচিত্রসংবলিত জাতীয় পতাকা। বদলাই কী করে? তাঁর জিজ্ঞাসা।
বলা হলো, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এ ব্যাপারে কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়তো নিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে তাঁর নাকি এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
জাতীয় সংগীত? সুন্দর, জনপ্রিয় এই সংগীতের সুরটি যে রক্ত টগবগানো নয়? কিন্তু তবু তো মেনে নিতে হবে। লাখো শহীদের রক্তস্মৃতি জড়ানো এই গান।
আর সরকার? কেন, সংসদীয়ই তো হওয়া উচিত, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।