১ জুলাই ২০১৬ সালে পবিত্র মাহে রমজানের সন্ধ্যায়, ইফতারের ঘণ্টা দুয়েক পর, ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বোমা আর গোলাগুলির ত্রাসজাগানো বিকট সব আওয়াজ বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল যে এখন বাংলাদেশও একটি সন্ত্রাসকবলিত রাষ্ট্র। সেই রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ সেই রাতে যে নির্মম হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হলো, বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতায় তার তুলনা মেলা ভার। প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি আজ ব্যথিত ও স্তম্ভিত। গুলশান আর শোলাকিয়া, হয়তোবা এই বাংলার মাটিতে তারপরও ঘটবে আরও সন্ত্রাসী বর্বরতা; তবে শোকাহত বাংলার আপামর জনসাধারণের একান্ত আশা যে দলীয় রাজনীতির অদূরদর্শী প্রাত্যহিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আমরা অচিরেই আমাদের জাতীয় জীবনে এই অন্ধকার সময়ের পুনরাবৃত্তির চির অবসান ঘটাব। কারণ তার ওপরই নির্ভর করছে একটি সভ্য প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে আমাদের বিবর্তনের সম্ভাবনা। এই সংগ্রামে আমাদের ব্যর্থতা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। এই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার মৌলিক প্রশ্নটি।
ইতিহাসের কত-না শতাব্দীর জোয়ার-ভাটা পাড়ি দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ঘাটে আমাদের তরি ভিড়িয়েছি। অতএব, এখন বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা, ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আমাদের সামনে রয়েছে কণ্টকাকীর্ণ পথ। ক্ষমতা দখলের রাজনীতির বুলি আওড়িয়ে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। রাজনীতিতে মত আর পথের ভিন্নতা থাকা অনিবার্য। এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা অপরিহার্য। তবে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার এই সংগ্রামে আমাদের একজোট থাকতেই হবে, ঠিক আমরা যেমন ছিলাম আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে আমাদের স্বাধীনতা আর মুক্তির সংগ্রামে।
মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির এক প্রসন্ন প্রভাতে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে বাংলাদেশ পানে তাঁর যাত্রাপথে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে আমার এই যাত্রা।’ আমাদের গত সাড়ে চার দশকের ইতিহাস সাক্ষী যে আমরা সেই আলোকিত গন্তব্যে পৌঁছানো তো দূরের কথা, যাত্রাপথে আমরা বারবার অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করছি। কখনো সামরিক শাসনের নামে, কখনো অকারণে দীর্ঘায়িত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মবেশে। এই পৌনঃপুনিকতার অবসান আমাদের ঘটাতেই হবে। অব্যাহত রাখতেই হবে আলোকের পথে আমাদের যাত্রার।
আজ আমি কলম ধরেছি গুলশানের হত্যাযজ্ঞের সুবিশাল বিয়োগান্ত উপাখ্যানেরই অংশ, একটি মানবিক কাহিনির বর্ণনায়। গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নিহতদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী—ফারাজ হোসেন আর অবিন্তা কবির ছিল ৮২ বছর বয়সের হতভাগ্য এই আমার কাছে থেকে দেখা অতিপ্রিয় মানুষ। ফারাজ আমার অনুজপ্রতিম লতিফুর রহমান ও তার স্ত্রী জরুর নাতি আর অবিন্তা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনজুর মূর্শেদ ও তার স্ত্রী নীলুর নাতনি। এই নিবন্ধটি তাদের প্রতি আমার স্নেহ আর ভালোবাসার অর্ঘ্য। ফারাজের বীরোচিত মৃত্যুর কথা নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। বিভীষিকাময় সেই রাতে ফারাজ এবং তার ঢাকার স্কুলজীবনের দুই বান্ধবী অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন গুলশানের সেই রেস্তোরাঁয় একই টেবিলে বসে ছিল। ফারাজ অবিন্তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিল আর ঢাকায় বসবাসকারী ভারতীয় তরুণী তারিশি পড়ত যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকার স্কুলজীবনের এই তিন বন্ধু এখানে এসেছিল তাদের গ্রীষ্মের অবকাশে। ফারাজ তার জীবন রক্ষায় দুই বান্ধবীর সঙ্গত্যাগ করল না। আত্মাহুতি দিল। ফারাজের বীরোচিত এই মৃত্যুর কাহিনির পরতে পরতে মিশে আছে আমাদের গর্বের উপাদান। ফারাজের মৃত্যুতে এক ঝলকের জন্য হলেও গভীর বেদনায় আমি দেখি প্রকৃত বাংলার মুখ। সাহসী, সংবেদনশীল, সহমর্মী। অকুতোভয় বাঙালি, চিরঞ্জীব বাংলাদেশ।
অবিন্তা, আমার অতি স্নেহের অবিন্তা। এই ঢাকায় আমাদের চোখের সামনে মেয়েটি বেড়ে উঠল। সদা চঞ্চল মেয়েটিকে আমার খুব ভালো লাগত। মনে পড়ে, তার বয়স তখন চার কি পাঁচ, একদিন তাকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অবিন্তা, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’ বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে, ঊর্ধ্বমুখে আমার দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে সে বলেছিল, ‘না, তোমাকে আমি বিয়ে করব না। তুমি আমার নানা।’ এই প্রত্যাখ্যান ভুলবার নয়! তার নানা, নানি, আমার স্ত্রী আর আমি প্রচুর হেসেছিলাম সেদিন। অবিন্তাকে আমি আর আমার স্ত্রী ‘প্রিন্সেস’ বলে ডাকতাম। আমাদের বুড়ো বয়সের নিঃসঙ্গ জীবনে অবিন্তা ছিল দমকা হাওয়ার মতো, তাজা আর তৃপ্তিদায়ক। কয়েক বছর আগে আমেরিকা থেকে আসার সময় অবিন্তা আমার জন্য একটি সুন্দর বেগুনি রঙের শার্ট কিনে এনেছিল। আমার জীবনের বাকি দিনগুলোতে এই শার্টটি এখন অবিন্তার স্মৃতি হয়ে থাকবে।
অবিন্তার বাবা, মোহাম্মদ এহসানুল কবির যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে ব্যবসারত। তাদের একমাত্র সন্তান অবিন্তার জন্যই প্রধানত ঢাকায়ই অবস্থান ছিল অবিন্তার মা রুবার। ঢাকায় রুবার ব্যবসা রয়েছে। ঢাকার ‘এলিগেন্ট’ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির সে চেয়ারপারসন আর ডিরেক্টর। প্রধানত ঢাকায়ই বড় হয়েছিল মাত্র ১৯ বছরের অবিন্তা। ২০১৫ সালে সে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। প্রথমে তার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু ডাক্তারি পাস করতে সময় লাগে প্রচুর। লেখাপড়া শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে যে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। এখানে তার রয়েছে অনেক কাজ। তার স্বপ্নভরা চোখে দুটি বাসনা। এখানের গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য একটি বড় আকারের প্রতিষ্ঠান সে গড়ে তুলবে। আর দ্বিতীয়ত সে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য স্থাপন করবে একটি বৃদ্ধাশ্রম। তার এ দুটি ইচ্ছা সে তার মাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। মা রুবা কথা দিয়েছিল এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সব সময় অবিন্তার পাশে থাকবে।
মেধাবী অবিন্তা তার ভালো ফলাফলের জন্য চার বছরের কোর্স সাড়ে তিন বছরে সমাপ্ত করার অনুমতি পেয়েছিল। তারপরই সে ফিরে আসবে এই বাংলায়। তার এ দুটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন সে করবেই। সাড়ে তিন বছরের এক বছর তো কেটেই গেল। আর রয়েছে আড়াইটি বছর। তা–ও কেটে যাবে। অবিন্তা ফিরে আসবে তার প্রিয় বাংলাদেশে। মা যেন তার ফিরে আসার সব প্রাথমিক ব্যবস্থা করে রাখে।
আটলান্টায় বসেও অবিন্তা বাংলাদেশকে এক মুহূর্তের জন্যও ভোলে না। হোস্টেলে আর কামরায় তার শিয়রের ডান পাশের দেয়ালে আঁটা রয়েছে সুবিশাল লাল-সবুজ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিন্তার ইতিহাসের শিক্ষক ডেভিড লেইন ওয়েবার অবিন্তার মৃত্যুতে শোকবার্তায় তার মা রুবাকে লিখেছেন, ‘অবিন্তা ক্লাসে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, কৃষ্টি ও ইতিহাসের প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলত।...আমাদের আলাপ-আলোচনায় অবিন্তা বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার দৃষ্টিকোণ থেকে, তার জ্ঞান আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করত এবং আমি জানি এতে তার ক্লাস খুব উপকৃত হতো...।’
দিন দুয়েক আগে আমি অবিন্তার মা রুবার সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি বিশ্বের বেদনা দেখেছি রুবার শোকাহত মুখাবয়বে, আর দেখেছি প্রত্যয়ের ছাপ। আর তা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যেই সে তার একমাত্র সন্তানের দুটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেই। গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর একটি বৃদ্ধাশ্রম রইবে অবিন্তার স্মৃতির বাহক হয়ে। আর মা রুবার একমাত্র পরিচয় হবে ‘অবিন্তার মা’ হিসেবে। আমি বিশ্বাস করি রুবা তার লক্ষ্যে একদিন পৌঁছাবেই। এভাবেই বেঁচে রইবে অবিন্তা। সেদিনই দেখা হলো অবিন্তার বান্ধবী গাব্রিয়েলার সঙ্গে। অবিন্তার খবর পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছুটে এসেছে মেয়েটি। অবিন্তার জন্য তার মন কাঁদে।
অবিন্তা ছুটি কাটাতে দেশে ফিরেছিল গত ২৭ জুন। ৩০ জুন রাতে অবিন্তার নানা–নানি মনজুর আর নীলু মূর্শেদের বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণে গিয়েছি আমার স্ত্রী আর আমি। নৈশভোজ শেষ হয়েছে। আমরা বাড়ি ফিরব। কোথা থেকে জানি অবিন্তা এসে হাজির। অনেক দিন পর তার সঙ্গে দেখা। জড়িয়ে ধরল আমার স্ত্রী আর আমাকে। দীর্ঘাঙ্গী, ঋজু, সুদর্শনা অবিন্তা। বাসার লিফটে নিয়ে গেল আমাদের দুজনকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। অবিন্তাকে আমার জিজ্ঞাসা, ‘তুমি কত্তো লম্বা অবিন্তা?’ ‘নানা, আমি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি’, মৃদু হেসে তার উত্তর। অবিন্তাকে বললাম, তাহলে তো সে অনায়াসে একজন মডেল হতে পারে। সলজ্জ হাসিতে সে জানাল যে একটি মডেলিং সেশনে সে ইতিমধ্যে অংশ নিয়েছে। আমি বললাম, ‘চমৎকার। আর সারা জীবনই তো তোমার পড়ে রয়েছে।’
এ কথাটি বলার মাত্র বিশটি ঘণ্টার মাথায়, পয়লা জুলাই রাতে, কিছু নরপিশাচের হাতে নির্বাসিত হলো অবিন্তার জীবনপ্রদীপ। একই সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ফারাজ হোসেন, ইশরাত আখন্দ, ভারতের তারিশি জৈন, ইতালি ও জাপানের ১৬ জন পুরুষ আর নারী, যাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে বিবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। বীরোচিত মৃত্যুবরণ করলেন আমাদের দুজন পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ও সালাহউদ্দিন। আত্মঘাতী এই নরপিশাচের দল শুধু যে কিছু মানুষের ওপর আঘাত হেনেছে তা-ই নয়, তারা আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের মর্মে। এ ধরনের জীবদের নির্মূল করা এখন বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক দায়িত্ব।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
[email protected]