এখন সবার প্রশ্ন স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে। আর কত দিন আমরা বসে থাকব? প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক। লেখাপড়া নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা নিশ্চয়ই থাকবে।
আবার একই সঙ্গে ভাবতে হবে, স্কুল খোলার পর যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তাহলেও তো বিপদ। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কুল খোলার পর অনেক শিক্ষার্থী কোভিডে আক্রান্ত হলে স্কুল আবার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। একটি শিশু আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্য সবাই ঝুঁকিতে পড়েন। সবার বাসায় হয়তো একটি আক্রান্ত শিশুকে একেবারে আলাদা ঘরে রেখে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তখন কয়েক দিনের মধ্যে বাসার সবাই আক্রান্ত হবেন।
তাই নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সময় হলে স্কুল খোলা হবে। এর মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যতটা সম্ভব আমাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে পড়া চলবে না। কিন্তু ‘সময় হলে’ কথাটার সুনির্দিষ্ট অর্থ কী? ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির ঘোষণা রয়েছে। এর আগেই পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
অবশ্য এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে অথবা সরাসরি কলেজে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অক্টোবর থেকেই অনলাইনে ক্লাস শুরু হবে বলে বোর্ডগুলো জানিয়েছে। এটা সুসংবাদ। সমস্যা হলো অনেকে হয়তো অনলাইনে ক্লাসের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না। তাদের জন্য বিটিভিতে নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। যদি এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়, তাহলে কিছুটা কাজ হবে বলে আশা করা যায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সেদিন প্রথম আলো ও সেভ দ্য চিলড্রেনের উদ্যোগে একটি ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। সেখানে প্রায় সবাই বলেছেন, করোনা সংক্রমণের হার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলগুলো খুলে দেওয়াই ভালো। শিক্ষার্থীদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দূর না হওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখার কথা সবাই বলেছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক শিক্ষাকে আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে বলেন, লেখাপড়া শুধু বই পড়ে কিছু তথ্য শেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, মতবিনিময় এবং ক্লাসে একসঙ্গে পড়াশোনার মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষা হলো একদিকে পড়াশোনা এবং একই সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ও ভাব বিনিময়ের মিথস্ক্রিয়া। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আমরা অনেকেই সাধারণত এভাবে শিক্ষাকে দেখি না। ফলে শিক্ষা কেবল মুখস্থবিদ্যার মধ্যেই আটকে থাকে। এই বেড়াজাল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আরও ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ। তিনি জানিয়েছেন, রেডিওতে প্রচারিত শিক্ষা কার্যক্রমে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। আর সৈয়দ গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, কয়েকটি জেলা-উপজেলায় তিনি দেখেছেন অনেক স্কুলে শিক্ষকেরা এখন ফলপ্রসূভাবে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। এই দুই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, স্কুল বন্ধ থাকলেও লেখাপড়া একেবারে বন্ধ নয়।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী জোর দিয়ে বলেছেন, সরকার যেন শিক্ষার্থীদের মাস্ক সরবরাহের দায়িত্ব নেয়। এটা তো করতেই হবে। না হলে হয়তো অনেকের পক্ষে মাস্কের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। সেভ দ্য চিলড্রেনের উপপরিচালক সৈয়দ মতিউল আহসান শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণের কথা বলেন। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে স্কুলে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে কি না, সে বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়ার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। এটা এখন সত্যিই জরুরি। কারণ, করোনা আমাদের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাই শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দরকার।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি ও কোভিড-১৯ জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, অক্টোবরে পরিস্থিতি দেখে স্কুল খোলা ও পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই তিনি এ রকম ভাবছেন। আমরাও মনে করি, অসময়ে শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই বাড়তি ঝুঁকিতে ফেলা ঠিক হবে না।
তবে আজ হোক বা কাল, স্কুল-কলেজ তো খুলবেই। শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা প্রস্তুত। করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। মূল চ্যালেঞ্জ হলো দৈনন্দিন জীবনাচার, প্রচলিত ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন সাধন এবং নতুন ধারায় অভ্যস্ত হওয়া।
যেমন বাসার বাইরে মুখে মাস্ক পরা, ভিড় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা এবং একে অপরের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব অন্তত তিন ফুট রেখেও মনের দূরত্ব আগের মতোই একেবারে কমিয়ে আনা, কিছু সময় পরপর সাবান-পানিতে হাত ধোয়া। এই কয়েকটা শর্ত যদি আমরা সবাই মেনে চলি, তাহলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকটাই কমানো সম্ভব। পরিস্থিতি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে হয়তো আরও বেশ কিছু সময় আমাদের এই পরিবর্তিত জীবনাচার মেনে চলতে হবে।
প্রশ্ন হলো, আমরা এই পরিবর্তিত জীবন-সংস্কৃতি কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করতে কতটা প্রস্তুত? যদি এই সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলো সত্যিই আমাদের জীবনের অঙ্গ করে তুলতে পারি, তাহলেই আমরা বলতে পারব, স্কুল-কলেজ খুলে পুরোদমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কোনো সমস্যা নেই।
আমরা সবাই সেটাই চাই।
আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক