চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ–এ যখন আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু, তখন নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর অভিভাবকত্ব পেয়েছি। আমাদের পালাপ্রধান (শিফট ইনচার্জ) ছিলেন নাসির ভাই। পরে বার্তা বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। নিরীহ ধরনের মানুষ, কম কথা বলেন, ঘাড় গুঁজে কাজ করেন। তবে কাজের বাইরে নানা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও জানাশোনা, সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ে সমঝদারির পরিচয়ও পেয়েছি। আর একটি পরিচয় অজানা ছিল। সেটি জানলাম একটি ঘটনার সূত্রে।
তখন জাতীয় পার্টির আমল। পত্রিকা অফিসে রাতের পালার কাজ চলছিল, হঠাৎ উদ্যত বন্দুক হাতে বার্তাকক্ষে প্রবেশ করলেন জাতীয় পার্টির এক স্থানীয় নেতা। কোনো সংবাদ নিয়ে হয়তো অসন্তুষ্ট ছিলেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে অশ্লীল গালাগাল করতে করতে ঢুকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ফিল্মের কায়দায় বন্দুকে গুলি ভরে নিচ্ছিলেন। বার্তাকক্ষের সাংবাদিকদের মধ্যে ছোটাছুটি, কেউ পাশের কক্ষে আশ্রয় নিলেন, কেউ দরজার পাশে নিজেকে আড়াল করে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। কিন্তু একজন দাঁড়িয়ে গেলেন—তিনি নাসির ভাই। ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে ফেললেন অস্ত্রধারীকে, কেড়ে নিলেন বন্দুক ও গুলি। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বলতে অস্ত্রধারীকে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন।
এরপর থেকে নিম্নকণ্ঠ, নিরীহ গোছের মানুষটা সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে গেল আমাদের। কী করে সম্ভব হলো? এত সাহস তিনি কোথায় পেলেন? জানতে পেরেছিলাম নাসিরুদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অস্ত্রচালনার ট্রেনিং নিয়েছেন। সফল-ব্যর্থ অনেক অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। মৃত্যুকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ফলে নিরীহ কলমজীবীর পেশা বেছে নিলেও প্রয়োজনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেননি।
আজ এত দিন পর নাসির ভাইয়ের কথা এল মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় ঘোষণার সূত্রে। মীর কাসেম একাত্তর সালে চট্টগ্রামে ডালিম হোটেলে যে নির্যাতনকেন্দ্রটি গড়ে তুলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাকে উল্লেখ করেছে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বলে, সেই মৃত্যুর কারখানায় মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী।
রায় ঘোষণার পর অনুভূতি জানার জন্য গিয়েছিলাম নাসির ভাইয়ের বাসভবনে। স্বস্তি প্রকাশের পর বললেন সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা: বৈদ্যুতিক শক, পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে লাঠিপেটা, শরীরের সংবেদনশীল স্থানগুলোতে উপর্যুপরি আঘাত। সহযোদ্ধারা কে কোথায় আছে, অস্ত্র কোথায়—এসব তথ্য আদায়ের জন্য অত্যাচার চলেছে দিনের পর দিন। সেখানে মাঝে মাঝেই মীর কাসেম আলী হাজির হতেন। সহচরদের কাছে জানতে চাইতেন কিছু বের করা গেছে কি না। ‘না’ শোনার পর আরও ক্ষিপ্ত ও নির্দয় হয়ে উঠতেন আলবদর বাহিনীর নেতা। আরও কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে বেরিয়ে পড়তেন।
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়াসহ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে পাহাড়ি পথে রামগড়ে পৌঁছেছিলেন। সেখানে তৎকালীন ছাত্রনেতা এস এম ইউসুফের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানিয়েছিলেন, সীমান্তের ওপারে সাব্রুমের বিএসএফ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং চলছে। সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
ফেনী নদী পার হয়ে সাব্রুম বিএসএফের ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। বিপ্রদাশ বড়ুয়া চলে যান স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। সাব্রুমে এক সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে সাতজনকে বাছাই করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শহীদ শাহআলম বীর উত্তম, রণবিক্রম ত্রিপুরা, আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম চিশ্তী ও মাহবুবুল আলম। তাঁদের পাঠানো হয়েছিল হরিনা ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পে তখন অবস্থান করছিলেন মেজর রফিক, মেজর জিয়াউর রহমান, মীর শওকত আলী, কর্নেল মাহফুজ প্রমুখ। সেখান থেকে পাঠানো হলো মিজোরাম লোয়ার হাফ লং ক্যাম্পে। সেখানে মাস দেড়েক প্রশিক্ষণের পর ফেনী নদী পেরিয়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম অপারেশনটি হয়েছিল সার্জেন্ট আলমের নেতৃত্বে আনোয়ারা থানায়। সেই অপারেশনে থানা দখল করে অস্ত্রশস্ত্র লুট করে এনেছিলেন তাঁরা। এরপর আরও কয়েকটি সফল-ব্যর্থ অপারেশন করেছেন বিভিন্ন এলাকায়।
অক্টোবরে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছান নাসিরুদ্দিন। যোগাযোগ হয় কমান্ডার মাহবুবের সঙ্গে। চন্দনপুরা জয়নগর এলাকায় রাজাকারদের এক ঘাঁটিতে ঈদুল ফিতরের আগের দিন আক্রমণের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা টহল বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় আক্রমণের পরিকল্পনা আপাতত বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন অগ্রজ মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু কমান্ডার মাহবুব ও নাসির ছিলেন স্থির সংকল্প। যথাসময়ে একটি অটোরিকশা নিয়ে রওনা হয়েছিলেন চকবাজারের উদ্দেশে। বাড়িটা আগের দিন চারপাশ থেকে দেখে এসেছিলেন তাঁরা। কথা ছিল দরজা দিয়ে সোজা ঢুকে ব্রাশফায়ার করবেন মাহবুব, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে প্রহরা দেবেন নাসির। কিন্তু কক্ষে প্রবেশের সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মাহবুব। নাসিরুদ্দিন কালবিলম্ব না করে জানালা দিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরেছিলেন কক্ষে থাকা সব রাজাকারকে। পরদিন স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে এ ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
ওই সময় নাসিরুদ্দিনকে আন্দরকিল্লার নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন সৈয়দ মঈনউদ্দিন হোসাইন (বর্তমানে চট্টগ্রামের সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পিতা)। ৩০ নভেম্বর বা ১ ডিসেম্বর পথে দেখা হয়ে গেল এক যুবকের সঙ্গে, যিনি সাব্রুমে একসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ‘সহযোদ্ধা’কে দেখে সাম্প্রতিক অপারেশনের সাফল্যের কথা বলেছিলেন প্রবল উৎসাহে। কিন্তু তখন তিনি জানতেন না ওই যুবক ছিল পাকিস্তানি চর। ভারতে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।
পরদিনই আন্দরকিল্লার সেই বাড়ি ঘেরাও করে বদর বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায় নাসিরুদ্দিনকে। সেই যে ডালিম হোটেলের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢুকেছিলেন, তারপর থেকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। নিজের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন, অন্যান্য বন্দীর আর্তনাদ শুনে শুনে মৃত্যু অনিবার্য ভেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে বদর বাহিনীর লোকদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় উত্তেজনা ও আতঙ্ক টের পাচ্ছিলেন। সম্ভবত ১৪ ডিসেম্বরের দিকে ডালিম হোটেল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল তারা। ১৬ ডিসেম্বর এলাকার মানুষজন এসে বন্দীদের উদ্ধার করে। উল্লসিত জনতার মুখে তাঁরা শুনতে পান দেশ স্বাধীন হয়েছে!
এই গল্প নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর একার নয়। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে এখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতিত সাইফুদ্দিন খান অতৃপ্তি নিয়ে মরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী, সানাউল্লাহ চৌধুরী, সৈয়দ এমরান, ইরশাদ কামাল খান এখনো বেঁচে আছেন সেই নির্মম নির্যাতনের স্মৃতি বহন করে। মীর কাসেমের রায় বহাল থাকার খবর শুনে তাঁরা সুখ ও স্বস্তির কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এ রায় যেন ইতিহাসেরই দায়মুক্তি।
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নন্দনকানন এলাকার মহামায়া ভবনটি, যেটি দখল করে ‘ডালিম হোটেল’ নামের মৃত্যু কারখানায় রূপান্তর করেছিলেন আলবদর নেতা মীর কাসেম। চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই এলাকায় ‘দোস্ত বিল্ডিং’ ও ‘দেওয়ান হোটেলে’ আরও দুটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল তাঁর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালিয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে দেশে ফিরে এসে কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশ থেকে এনজিওর নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজে বিত্তবান হয়েছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এ দেশের বিরুদ্ধে নানা কর্মকাণ্ডে। মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগও আছে।
রায়ের পর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘টাকা দিয়ে বাংলাদেশকে কিনতে পারেনি মীর কাসেম।’ নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় একই কথার প্রতিধ্বনি শুনি তাঁর মুখেও, সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মীর কাসেমের বিচারের মাধ্যমে এ দেশ কলঙ্কমুক্ত হলো। এবার তাঁর আদর্শকে মাটিচাপা দিতে হবে। সেই দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের তরুণদের হাতে। তারা যেন একটি জাতির জন্মলগ্নের ইতিহাস ভুলে না যায়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]