সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে হাজার প্রশ্ন
এক যুগ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নের জট খুলল না। শিক্ষকেরা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেননি। না শিক্ষাদানে, না প্রশ্ন প্রণয়নে। চলতি মাধ্যমিক পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন নিজেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। সব প্রশ্ন নাকি এসেছে বিদ্যা-বণিকদের গাইড বই থেকে। হুবহু। তাই নিয়ে গোসসা। সমালোচনার ঝড়। সর্বমহলে। বিশেষ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি এ দেশে সৃজনশীল শিক্ষা ও সৃজনশীল প্রশ্নের অন্যতম স্বাপ্নিক। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যিনি বাংলায় সৃজনশীল প্রশ্নই তৈরি করতে পারেন না, তিনি পড়ান কী করে? কেমন শিক্ষক তিনি?
প্রশ্নটি শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবালের একার নয়, প্রশ্নটি গোটা দেশের কোটি কোটি মানুষের। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। এর পাঁচ ভাগের চার ভাগই প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকের। আর এদের সবাকেই সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ২০০৯ সালে যাঁরা সৃজনশীল প্রশ্নে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এত দিনে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে থাকবেন। মোটাদাগে বললে সৃজনশীল প্রশ্নের পরীক্ষা দেওয়া প্রথম প্রজন্মের ইতিমধ্যে কর্মপ্রবেশ ঘটে গেছে। তাঁদের অনেকের সন্তানাদি হয়তো আগামী দু-এক বছরের মধ্যে বিদ্যালয়ে পা রাখবে। কিন্তু সৃজনশীল শিক্ষা আর সৃজনশীল প্রশ্নের শৈশব যেন কাটছেই না। এই অঞ্চলে পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্র ‘শিশু’ থেকেই মরে গিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সৃজনশীল শিক্ষা আর প্রশ্নের বয়স পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার আধেককাল কাটিয়ে ফেলেছে। তবে কি সৃজনশীল পদ্ধতি পঞ্চত্ব পেতে চলেছে?
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী স্যামুয়েল বেঞ্জামিন ব্লুম (১৯১৩-১৯৯৯) বিশ শতকের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। তাঁর টিম দীর্ঘ পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ শেষে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি উদ্ভাবন করে। ১৯৫৬ সালে সে আবিষ্কার সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দেয়। এ পদ্ধতিতে শিক্ষকের পরিবর্তে পড়ুয়াকে শিক্ষার কেন্দ্রে বিবেচনা করা হয়। শিশু প্রকৃতিগতভাবেই অনুসন্ধিৎসু। তাই শিশুকে টেবুলা রেসা বা সাদা পাতা হিসেবে গণ্য করা হয় না। প্রকৃতি ও পরিপার্শ্ব থেকে, পরিবার ও সমাজের নানাজনের কাছ থেকে শিশু বিস্তর জ্ঞান নিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষকের দরজায় হাজির হয়। তাই শিক্ষকের কাজ হওয়া উচিত শিশুর অসীম জানার আগ্রহকে আরও তাতিয়ে দেওয়া। ব্লুমের শিক্ষাতত্ত্বে (ব্লুম টেক্সোনমি) এরই নির্দেশ করা আছে ছয় ধাপে—স্মরণ (রিমেম্বারিং), বোঝা বা অনুধাবন (আন্ডারস্টান্ডিং), প্রয়োগ (অ্যাপ্লাই), বিশ্লেষণ (এনালাইজ), মূল্যায়ন (ইভ্যাল্যুয়েট) ও সৃজন (ক্রিয়েট)।
আরও সহজ করে বললে ১. আমি জানি, ২. আমি বুঝি, ৩. আমি ব্যবহার (প্রয়োগ) করতে পারি, ৪. আমি ব্যাখ্যা (বিশ্লেষণ) করতে পারি, ৫. আমি বিচার (মূল্যায়ন) করতে পারি এবং ৬. আমি সৃজন করতে পারি। লক্ষণীয়, ব্লুমের শিক্ষাতত্ত্বে আমি হচ্ছে শিক্ষার্থী নিজে।
সেটা কোনো একঘেয়ে নিয়মে বেঁধে করা যায় না। শিক্ষককে তাই প্রথমেই পড়ুয়ার সাথি বা বন্ধু হতে হয়। শিশুর বোধগম্য ভাষায় কথা বলতে শিখতে হয়; আবার শিশুকে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রও শেখাতে হয়। কাজটি জটিল ও বেশ কষ্টসাধ্য। এ জন্য শিক্ষককে হতে বিপুল ধৈর্যের অধিকারী ও কৌশলী হতে হয়। এই কৌশলী শিক্ষকই সৃজনশীল। অর্থাৎ, পড়ুয়ার চাহিদামতো শিক্ষক নিজেকে প্রতিনিয়ত নিজেকে তৈরি করবেন, পরিবর্তিত হবেন। শিশুর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের রূপান্তর প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। সে কারণে, কোনো কেতাবি ঘরানায় পঠন ও পাঠন চলে না।
প্রতিটি পাঠই নতুন করে সাজাতে হয়, নিত্যনতুন মাল-মসলায়, উপকরণে, ব্যাখ্যায়, বিশ্লেষণে। তাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই একই সঙ্গে সৃজনশীল হয়ে ওঠে এবং প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে অন্তহীন চক্রে বা আবর্তনে। মাও সে-তুং যেভাবে তাঁর ‘প্রয়োগতত্ত্ব’ (অন প্র্যাকটিস) খাড়া করেছেন, অনেকটা সে রকমভাবে।
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক এই পদ্ধতি গত এক যুগেও রপ্ত করতে পারেননি। অথচ কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এ পদ্ধতি চালু করতে। বিদেশ সফর হয়েছে—এমন অনেকের যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কারও-বা দায়িত্ব ছিল শিক্ষক বাছাইয়ের। তা করতে গিয়ে নিজেকেই সবচেয়ে যোগ্য গণ্য করে সবার আগে বিদেশে ভ্রমণ সেরে নিয়েছেন।
কিছু শিক্ষককে ডেকে ১২ দিনের হযবরল শিখিয়ে মাস্টার ট্রেনার তকমা দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন মাত্র তিন দিনে স্কুলশিক্ষকদের সে বিদ্যার জাহাজ বানাতে। ওদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কিছু লোকের গলায় সৃজনশীল পুস্তক প্রণেতার সিলমোহরযুক্ত মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছে। সে সনদ পেয়ে তাঁরা ভারী ভারী কেতাব লিখেছেন। সেসব কেতাবে বাংলাবাজার থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত সৃজনশীল পুস্তকে দেশ ভাসিয়ে দিয়েছেন বিদ্যা-বাণিজ্যের জাহাজিরা। একটি শিক্ষা বোর্ড কয়েক বছর ধরে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে তাদের সার্ভার ভরে রেখেছে। কিন্তু তাতেও সৃজনশীল বাঙালি শিক্ষক না পেরেছেন সৃজনশীল শিক্ষক হতে, না পারছেন সৃজনশীল প্রশ্ন বানাতে। এমন নিষ্ফলা কৃষক বাঙালি আগে কখনো দেখেনি।
কিন্তু বাংলার পলিসমৃদ্ধ উর্বরা ভূমি এমন মরুভূমির মতো নিষ্ফলা হলো কেন? নিশ্চয়ই তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। সেটি অনুসন্ধান করাই এখন জরুরি।
অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণ দুর্নীতি। দ্বিতীয় কারণ দলবাজি ও স্বজনপোষণ। তৃতীয় কারণ ব্লুমতত্ত্বের অপব্যাখ্যা।
যাঁদের এত বড় কর্মযজ্ঞে শামিল করা হয়েছিল, তার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই ব্লুমতত্ত্ব জানতেন বা বুঝতেন। বিদেশি ঋণের সঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসে কিছু তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক হিসেবে তাঁদের তহবিলে ফেরত যায় ঋণের এক বড় অংশ। তার সঙ্গে যুক্ত থাকে দেশি-বিদেশি ঠিকেদার প্রতিষ্ঠান, গেজেট-ব্যাপারী, অসৎ রাজকর্মচারী। কিন্তু মুখোশ হিসেবে সামনে আনা হয় কিছু গোবেচারাকে। তাদের ব্যক্তিগত খ্যাতি পুঁজি করে চলে এসব প্রকল্প। পশ্চিমের এই ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম আট দশক ধরে আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা, গরিব দেশগুলোয় চলছেই। এটা এমন এক চক্র যে তা ভেদ করা কঠিন।
আরও একটি বিষয় ভাবতে হবে। যে দেশে যার কোনো গতি হয় না তাকে কয়েক লাখ নগদ নারায়ণ দিয়ে মাস্টারি কিনতে হয় এবং গোটা যৌবন দাসের মতো খেটেও যাদের এক পয়সা মজুরি মেলে না, চাইতে গেলে পুলিশের পিটুনি আর আমলা-কেরানিদের হুমকি খেতে হয়, সে দেশে সৃজনশীল শিক্ষক পাওয়া ‘কচুগাছে কাঁঠাল আশা’ করার মতোই আজব আবদার বটে।
সবশেষে একটি কথা বলি। এ দেশে কি একপ্রস্থ সৃজনশীল পাঠ্যপুস্তক লেখা হয়েছে? এনসিটিবির যে কর্তারা রাশি রাশি বইয়ে ‘সৃজনশীল’ সিলমোহর লেপ্টে দিয়েছেন, তাঁরাও কি তার যোগ্য ছিলেন?
যদি উত্তর না-সূচক হয়, তবে সৃজনশীল শিক্ষাদান এবং সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন অলীক কল্পনাই তো থেকে যাওয়ার কথা।
আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]