শতাব্দীর ভয়াবহ সংক্রামক কোভিড-১৯ আমাদের জীবনকে সংকটাপন্ন ও বিপর্যস্ত করে তুলছে। কোভিড-১৯ সৃষ্টি করেছে মহামারি। বিশ্বের ২১৩টি দেশে এ পর্যন্ত প্রায় নয় লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় পাঁচ হাজার। কোভিড-১৯–এর নিশ্চিত কোনো চিকিৎসা নেই বিধায় নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। গণমাধ্যম ব্যবহারের সীমাবদ্ধতায় জনগণের তথ্য আদান–প্রদানের বিষয়টি দুরূহ হয়ে উঠেছে এবং এই তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও চর্চা বিঘ্নিত হয়েছে।
দেশে গণমাধ্যম ব্যবহারের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ মানুষ, যাদের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬১ শতাংশ নারীর সংবাদমাধ্যম ব্যবহারের সময় নেই। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ লোক কোনো গণমাধ্যমই ব্যবহার করেন না।
মিডিয়া কনভারজন্সের কারণে তথ্য এবং বিনোদনের সব আধার কটি যন্ত্রে একীভূত হয়ে গেছে। মুঠোফোন একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠছে মানুষের যোগাযোগ ও সময় কাটানোর অবলম্বন। ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপকতা এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারে মানুষের আচার-আচরণ ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের আত্মস্থ করে নিচ্ছে। সংগত কারণেই তথ্যের অবাধ প্রবাহও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রচলিত টিভি, রেডিও, মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রভাব ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। কোভিড–১৯–এর সংক্রমণের কারণে এসব গণমাধ্যমের প্রচার, বিশেষ করে মুদ্রিত সংবাদপত্রের স্থান দখল করে নিচ্ছে অনলাইন ভার্সন। পশ্চিম দেশগুলোর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে তরুণ প্রজন্মের ৯৪ শতাংশ তাদের স্মার্টফোনে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে থাকে। (আইজে নেট ১০ আগস্ট ২০২০)।
তথ্যের এই প্রাচুর্য মানুষকে এক অর্থে দিশেহারা করে তুলেছে। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত ‘ওভারলোড অব ইনফরমেশন’ কিছু লোককে সহযোগিতা করছে বটে। কিন্তু এর অপব্যবহার ও বেহিসেবি ব্যবহার মানুষকে বিপথেও পরিচালিত করছে। তাই তথ্যের যথাযথ ব্যবহার ও সঠিক তথ্যের ব্যবহার জরুরি। অপর দিকে দেশের একটি বৃহৎ অংশ সার্বক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
ইন্টারনেটে যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করাও অনস্বীকার্য বলে বিবেচনা করা। আমাদের সংস্কৃতিতে তথ্য লুকানোর পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে আমরা সামাজিকভাবে এগিয়ে এসেছি। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের ধারাবাহিকতায় একটি মাইলফলক আইন হিসেবে। এটি একটি জনমুখী আইন। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ৭(১) প্রজাতন্ত্র অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ, এই মূলমন্ত্রই হচ্ছে এই আইনের অন্তর্নিহিত শক্তি। দেশের সামগ্রিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় জনগণের কল্যাণে এবং জনগণের জন্য। অথচ একাধারে ব্রিটিশ ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে জেঁকে বসে আছে, যার ফলে প্রশাসনের সঙ্গে জনগণরে দূরত্ব রয়ে গেছে। সম্প্রতি এই ধ্যানধারণার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মহান ঐতিহ্যে লালিত একটি ক্রম উন্নয়নশীল দেশ।
ঐতিহ্যগতভাবে দেশে যে আইনকানুন প্রচলিত আছে প্রগতির ধারায় তার অনেক সংস্কার হচ্ছে, চালু হচ্ছে নতুন আইন। দেশে ১১০০-এর বেশি আইন বলবৎ রয়েছে। বেশির ভাগ আইন চালু আছে জনগণের ওপর প্রয়োগ করার জন্য আর তথ্য অধিকার আইন হলো এমন একটি আইন, যা জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু তথ্য অধিকারচর্চা কাঠামোগত কারণে জনমুখী হয়ে উঠছে না। প্রায় এক যুগ পূর্তি হতে চলেছে এ–সংক্রান্ত আইন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার। একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১২ বছর সময় খুব বেশি নয়, আবার কমও নয়। তথ্য অধিকার আইনের ধারা ১০ অনুযায়ী প্রতিটি তথ্য প্রদানকারী ইউনিটের জন্য একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে থাকে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৫ হাজার ২৮৩ জনকে সরকারি অফিসে এবং ৬ হাজার ৯০৫ জনকে বেসরকারি অফিসে মোট ৪২ হাজার ১৮৮ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত আছে। তবে সরকারি অনুদানকৃত স্কুল–কলেজ ও সব ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত হলে তথ্য প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হয়তো আইনের সংশোধন প্রয়োজন হবে। সেই ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত তথ্য প্রদানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ২ মে পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ ছিল। ফলে সারা দেশে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি অফিস-আদালতও বন্ধ ছিল। জরুরি সেবাসমূহ ব্যতীত সব ধরনের কাজর্কম প্রায় বন্ধ। স্বাস্থ্যসেবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই সময় অফিসগুলো বন্ধ থাকায় তথ্যের আদান-প্রদান ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জানা যায়, সাংবাদিকেরা তথ্যের আবেদন করেও সফল হননি। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চালু থাকলেও তথ্য সরবরাহের সুযোগ সেভাবে জনগণ কিংবা সাংবাদিক গ্রহণ করতে পারেননি। এটিকে কাঠামোগত অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়।করোনাকালীন এই সংকটে মূলধারার গণমাধ্যম যখন তার পরিবেশনা ও সরবরাহ সীমিত করে ফেলেছে এবং জনগণ সামাজিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তখন জনগণকে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যে ধরনের অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি ঘটে চলেছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে সাংবাদিক তথা জনগণকে তাদের তথ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। আজকাল ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় যেকোনো নাগরিক তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন অনলাইনে ঘরে বসেই করতে পারেন। তাঁর তথ্যের আবেদন কোন পর্যায়ে আছে, সেটিও অনলাইনে ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হতে পারেন।তথ্য কমিশনে ২০০৯-১৪ সালে শুনানির জন্য গৃহীত অভিযোগের হার ছিল ৫২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৬৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৭৬ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৫৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। (সূত্র তথ্য কমিশন)। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তথ্য কমিশনে অভিযোগের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও শুনানির হার হ্রাস পেয়েছে। তথ্য অধিকার আইন জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য কমিশন সারা দেশে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ২০১৫ সালে ১২টি উপজেলায়, ২০১৬ সালে ১০২টি উপজেলায়, ২০১৭ সালে ১৫৪টি উপজেলায়, ২০১৮ সালে ৭৩টি উপজেলায়, ২০১৯ সালে ১৩১ উপজেলায় এ ধরনের সভার ব্যবস্থা করা হয়।২০১৫ সালে তথ্য কমিশনে দায়ের করা অভিযোগসমূহের মধ্যে শতকরা ১৭ ভাগ ছিল সাংবাদিকদের করা আর ২০১৬ সালে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২১ ভাগ। ২০১৭ সালে অভিযোগ দাঁড়ায় ৫৩০টি, তার মধ্যে ৪০৩টি শুনানি করা হয়, পেশা হিসেবে সাংবাদিকদের দায়ের করা অভিযোগ ছিল ৩১ ভাগ। ২০১৮ সালে ৪৩৮টি অভিযোগের শুনানি হয়, তার মধ্যে সাংবাদিকদের ৯০টি অর্থাৎ ২১ ভাগ। ২০১৯ সালে ৬৩০টি অভিযোগের মধ্যে শুনানি হয় ২৮৭টি, এর মধ্যে সাংবাদিকদের করা অভিযোগ ছিল ১৮ ভাগ। (সূত্র বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও তথ্য কমিশন)আমাদের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক্-স্বাধীনতা নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক্-স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য। জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং সুশাসন স্থায়ী হবে।আমরা এ–ও জানি যে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর কার্যকারিতার কারণে তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য গোপন করতে বা তার সহজলভ্যতাকে সংকুচিত করতে পারবে না। এই আইনের আলোকে সৃষ্ট তথ্য কমিশনের যে ভাবমূর্তি এবং কার্যকারিতা সর্বতোভাবে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করতে হব। তথ্য অধিকারচর্চা বেগবান করার লক্ষ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের, পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে, যাতে জনসচেতনতা আরও বাড়বে। দেশের ১৭ কোটি মানুষের দেশে তথ্যের জন্য বছরে মাত্র আট হাজার আবেদনপত্র একান্তই অপ্রতুল। শুধু স্বাভাবিক সময় নয়, সংকটকালেও মানুষের তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত রাখা প্রয়োজন। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই চর্চায় সক্রিয় থাকতে হবে। তথ্য অধিকারচর্চা গতিশীল করা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে তথ্য কমিশন কাজ করবে, এটাই কাম্য। তথ্য কমিশন এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে জনগণকে অধিকতর ক্ষমতায়ন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তথ্যভিত্তিক সমাজ গড়ে আমরা গুণগতভাবে আরও সমৃদ্ধ হব—এটাই তথ্য অধিকার দিবসের প্রত্যাশা।
মো. গোলাম রহমান, অধ্যাপক ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার