ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রণীত নতুন আচরণবিধি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর করেছেন। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক সংস্থার জন্য এই আচরণবিধি কীভাবে কতটা প্রযোজ্য হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠকের অ্যাজেন্ডায় বোধগম্য কারণেই এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। আমরা সব সময় বলে এসেছি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাতেও গলদ আছে। সে কারণে রায়ে যখন একে মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছে, তখন তা নিয়ে আমাদের চিন্তার অবকাশ আছে। ইতালির ভেনিসে সফররত বিচারপতি এম এ মতিনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হলো। তিনি বললেন, একে মৌলিক কাঠামো বলার বিপদ হলো সংসদ পরে এর সংশোধন করতে চাইলে কেউ গিয়ে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারে। বলতে পারে, এটি সর্বোচ্চ আদালত প্রণীত মৌলিক কাঠামো। তাই এর সংশোধনী চলবে না। অথচ এর উপযুক্ত সংশোধনী আনা ছাড়া আমরা চলতে পারি না।
এটা সত্যি বিস্ময়কর যে এত আলোড়ন, এত অনভিপ্রেত মন্তব্য, অথচ সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই। অ্যামিকাস কিউরিদের সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেখেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিঅ্যান্ডএজি) ওপর এর কী প্রভাব তা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সংবিধানে আচরণবিধি শুধু বিচারকদেরটাই প্রধান বিচারপতিকে করতে বলেছে, সেটাই শতভাগ আইনসিদ্ধ ব্যাখ্যা কি না? পুনরুজ্জীবিত ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপদফা বলেছে, বিচারকদের জন্য আচরণবিধি করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আর সংবিধানের অন্য তিনটি অনুচ্ছেদ (১১৮, ১২৭, ১৩৯) বলেছে, যেরূপ ‘পদ্ধতি ও কারণে’ বিচারকেরা অপসারিত হন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণে তাঁরাও অপসারিত হবেন। তাহলে যে আচরণবিধি বিলি করা হলো তার লঙ্ঘন হবে অপসারণের ‘কারণ’। তাহলে অন্যদের জন্য আপাতত এই আচরণবিধির যতটুকু প্রযোজ্য হয়, ততটা কার্যকর বলে গণ্য হওয়া উচিত। আর চূড়ান্তভাবে এই প্রশ্নের ফয়সালা হওয়া দরকার, অন্যদের ক্ষেত্রে আচরণবিধি কে কখন কী প্রক্রিয়া বা কোন বিধানের অধীনে তৈরি করে দেবে? সংবিধানের ওই তিনটি অনুচ্ছেদ ও সংসদের তিনটি আইনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যে প্রতিস্থাপিত হবে, সেসব বিষয়ে রায়ে কিছুই বলা হলো না কেন? অ্যামিকাস কিউরিদের কেউ এ বিষয়টি আদালতের নজরে নিয়েছিলেন বলে রায় পড়ে প্রতীয়মান হয় না।
অন্যদিকে প্রশ্ন হচ্ছে ৩৯ দফা আচরণবিধির কার্যকরতার বিষয়ে একটি সাংবিধানিক শুদ্ধতার প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে কি না?
৮ আগস্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকে স্বীকার করা হয়েছে যে ২০০০ সালের ৭ মে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সর্বশেষ আচরণবিধি প্রণয়নের পর থেকে ‘কিছু বিচারপতি এমন কিছু অসদাচরণে লিপ্ত রয়েছেন, যা একজন বিচারকের মর্যাদা এবং পেশাগত সক্ষমতা রক্ষার সহায়ক নয় (সাম মিসবিহ্যাবিরিয়াল কন্ডাক্টস আর বিয়িং ইনডালজড বাই সাম অব দ্য জাজেস হুইচ আর নট কন্ডিউসিভ ফর মেইন্টেনিং দ্য ডিগনিটি অ্যান্ড প্রফেশনাল কম্পিটেন্স বাই এ জাজ)।’ তার মানে দাঁড়ায়, গত ১৭ বছরে বিচারকদের কেউ কেউ এমন আচরণ করে থাকতে পারেন, যা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দ্বারা তদন্তযোগ্য বিষয় হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে তঁারা সংখ্যায় কত, তঁাদের পরিচয় কী, তঁাদের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত হবে কি না? ওই প্রথম বৈঠকে আরও স্বীকার করা হয়েছে যে ‘এর আগে আপিল বিভাগ বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানের মামলার রায়েও আচরণবিধি পরিমার্জন করেছিলেন। কিন্তু তা-ও অপ্রতুল বলে চিহ্নিত হয়েছে।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি ভূতাপেক্ষভাবে, ২০১৪ সালে বিলোপের তারিখ থেকে কার্যকর হবে নাকি আগের আচরণবিধি ৩০ জুলাই পর্যন্ত বহাল থাকবে ও নতুন আচরণবিধি ৩১ জুলাই ২০১৭ থেকে কার্যকর হবে? পরিষ্কার উত্তর আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে দেননি। এর আংশিক উত্তর মিলেছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রথম সভায়। এতে বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী আচরণবিধি এতদ্দ্বারা বাতিল করা হলো এবং এই আচরণবিধি ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল-সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপদফার ‘ক’তে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রণয়ন করবেন। আমরা জানি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধান বিচারপতি এবং তাঁর পরবর্তী দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত। কাকতালীয়ভাবে এই তিনজন সদস্য ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ের সাত বিচারপতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ওই তিনজনকে বাদ দিয়েও এই সাংবিধানিক মামলাটির শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করে দিতে পারতেন।
প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়ের ৩৮৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘কোনো ভুল-বোঝাবুঝির বা বিভ্রান্তি এড়াতে আমরা সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আচরণবিধি যথাযথভাবে প্রণয়ন (রি-ফরমিউলিট) করলাম।’ এখানে প্রশ্ন হলো রায় কার্যকর করার আগেই, অর্থাৎ রায় লেখার সময় ৯৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করা আইনসিদ্ধ কি না?
প্রধান বিচারপতি ৩৯৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, তর্কিত সংশোধনী দ্বারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে সংসদীয় অপসারণব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। যেহেতু এই সংশোধনী সংবিধানের ‘আলট্রা ভায়ারস বা আইনগত এখতিয়ারবহির্ভূত সে কারণে প্রতিস্থাপনের আগের অবস্থায় পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’ রায়ের উপসংহারে আদেশের অংশে বলা হয়েছে, ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, পুনরুজ্জীবিত করা হলো। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে এই প্রতিস্থাপন কোন তারিখ থেকে কার্যকর হবে বলে ধরে নেওয়া হবে? ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ উপদফায় বিচারকদের বয়স ৬৭ বছর থাকা এবং ৮ উপদফায় পদত্যাগ করার বিধান আছে। কেউ বলছেন, পদত্যাগ করার ক্ষমতা বিচারকেরা হারিয়েছেন। কারণ, রায়ে ১ এবং ৮ পুনরুজ্জীবিত করা হয়নি। আদালত হয়তো ধরে নিয়েছেন, এই দুটিতে যেহেতু হাত দেওয়া হয়নি, তাই এ দুটি আগের মতো টিকে আছে।
আমাদের বিবেচনায় তাই রায় দ্বারা ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যে তারিখে ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে সেই তারিখ থেকেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর হবে। এটাই সঠিক ব্যাখ্যা হওয়া উচিত, এর সুবিধা হলো তাহলে আর গত প্রায় তিন বছরব্যাপী কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় না। আইনের চোখে এটাই প্রতীয়মান হওয়া সংগত যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংশোধনপূর্ব ৯৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার ফলে কার্যত সংসদ কখনো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান রদ করেনি বলে গণ্য হবে। রায়ে অবশ্য ৯৬ অনুচ্ছেদকে ‘ভয়েড অ্যাবিনিশিও’ বা গোড়া থেকে বাতিল বলে গণ্য করেননি। গতকাল আমি আইনজীবী আমীর-উল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেননি।
আমরা যখন এ রকমেরই একটি ধারণা পোষণ করছিলাম, তখন ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এক পত্র মারফত সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের কাছে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতির প্রণীত এবং ছয় বিচারক দ্বারা নির্দিষ্টভাবে সমর্থিত আচরণবিধির কপি পৌঁছে দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে প্রাপ্ত ১২ পৃষ্ঠার আচরণবিধির সূচনা অংশে লেখা আছে, আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় আচরণবিধি সূত্রবদ্ধ (ফরমিউলিট) করেছে। ৮ আগস্ট ২০১৭ তা ৯৬(৪) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তা জারি (প্রমালগেট) করেছে।
৮ আগস্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ওই সভা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকে নেওয়া দুটি সিদ্ধান্ত বিচারকদের অবহিত করা হয়েছে। কোনো রায়ের ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, এমন সব মামলার রায়/আদেশ স্বাক্ষরদান শেষে নথিসমূহ আগামী ৪ অক্টোবরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রেরণের সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকের নির্দেশদানের সিদ্ধান্ত হয়। এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তবে আমরা খুশি হব প্রধান বিচারপতি যদি তাঁর নিজেরসহ সব বিচারপতির সম্পদের বিবরণী প্রকাশে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেন। নতুন আচরণবিধিতে এই ক্ষমতা তিনি আগের মতোই তাঁর কাছে রেখেছেন।
আমাদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি অনেক বেশি উৎসাহিত ও আশ্বস্ত করেছে। এ সিদ্ধান্তে লেখা আছে, ৪ অক্টোবরের পর প্রধান বিচারপতি এই কোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে কর্মরত বেঞ্চ অফিসার এবং সহকারী বেঞ্চ অফিসারদের বদলির আদেশ জারি করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বিচারপতি মোস্তাফা কামাল প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরপরই বেশ কিছু বেঞ্চ অফিসারকে বদলি করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই সিদ্ধান্তে অভ্যন্তরে বেশ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে শোনা, সেই অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তীকালে বেঞ্চ অফিসারদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের খবরাখবর আমাদের বিচলিত করেছে।
নির্বাচন কমিশনে সংলাপ গতকাল থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে। আমন্ত্রিত হয়ে এর আগে আমি গিয়ে অবশ্য বলেছিলাম, পরের নির্বাচনের আগে কমিশনারদের অপসারণপদ্ধতি চূড়ান্ত হতে হবে। এখন তো আমরা বলব, হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে?
প্রধান বিচারপতি জরুরি ভিত্তিতে রায়ের পরপরই সব বিচারকের কাছে আচরণবিধির কপি পৌঁছে দিলেন। তাহলে নির্বাচন কমিশনারদের কাছে কে দেবে? প্রধান বিচারপতি দায় নেবেন না। তিনি বলবেন, সংবিধান আমাকে সে সুযোগ দেয়নি। কিন্তু একেবারেই কি দেয়নি? এর উত্তর হ্যাঁ হলে তাঁর ব্যক্তিগত দায় ঘুচবে। কিন্তু আমাদের নাগরিক প্রয়োজন তো ঘুচবে না। আমরা মনে করি, সব সাংবিধানিক সংস্থার পদধারীদের জন্য আচরণবিধি তৈরির দায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এড়াতে পারেন না। কিন্তু রায় নিয়ে যে অভাবনীয় বেদনাদায়ক পরিবেশ বিরাজমান তাতে এর কোনো প্রক্রিয়া শুরু করতে বলাও তো বিপজ্জনক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷