ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বের ভূরাজনীতিতে দ্রুত কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ‘ধর্মযুদ্ধ’–এর মধ্য দিয়ে এর সূচনা করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি জো বাইডেন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে একত্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে, যাদের এই সংঘাতের সঙ্গে বিন্দুবিসর্গ সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে চীন তার চিরাচরিত নিরপেক্ষনীতি বজায় রাখতে পারেনি। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার যে বিপজ্জনক অবস্থান, তাতে অনেকটাই সমর্থন দিয়েছে চীন। বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানও তীব্র করেছে। চীনের সঙ্গেও পশ্চিমাদের মতপার্থক্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে স্পষ্ট যে ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর পর গোটা বিশ্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দাবা খেলার বোর্ডে পরিণত হয়েছে। এই খেলায় বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকায় নেমে পড়েছেন।
বাইডেন যখন এশিয়ার বাজারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, সি চিন পিং তখন বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় দাবার বোর্ডে নিজের চাল বদল করছেন। চীন এত দিন ধরে বিশ্বে তার অর্থনৈতিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠাকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করত। এখন সেটা দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সি চিন পিং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রতাপ রক্ষা করতে গেলে সামরিক দিক থেকেও প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে হবে।
এই খেলায় বাইডেন এরই মধ্যে তাঁর রণকৌশল স্পষ্ট করেছেন। সেটা হলো, মধ্য মেয়াদে ইউরোপে নয়, বরং এশিয়াতেই তিনি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চান। সম্প্রতি ইউরোপীয় কাউন্সিল ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রার্থী সদস্যের মর্যাদা দিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার তার পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতির মোড় এশিয়ার দিকেই ঘোরাতে চান।
বাইডেন তাঁর পররাষ্ট্রনীতি যে এশিয়ার দিকে ফেরাতে চান, তার দুটি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত সম্প্রতি আমরা দেখেছি। প্রথমটি হচ্ছে, মে মাসে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে একটি সম্মেলনে মিলিত হন তিনি। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আসিয়ান দেশগুলো তাদের নিরপেক্ষনীতি যেন বদল করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সম্মেলন হরিষে–বিষাদে পরিণত হয়, সিঙ্গাপুর ছাড়া কোনো দেশই সাড়া দেয়নি। সন্দেহ নেই, চীনের দিক থেকে আসা চাপের কারণেই দেশগুলোর এই অবস্থান। চীন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী ও প্রধান বিনিয়োগকারী।
দ্বিতীয়ত, হাল ছেড়ে না দিয়ে বাইডেন শিগগিরই এশিয়ায় তাঁর প্রথম সরকারি সফরের ঘোষণা দেন। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফর করেন বাইডেন। ধারণা করা হয়েছিল, বাইডেনের এই সফর তেমন কোনো সাফল্য আনবে না। কিন্তু নাটকীয়ভাবে ঘটনার মোড় পাল্টাতে শুরু করে। ইন্দো–প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) তৈরিতে বাইডেনের প্রস্তাবে ১২টি দেশ সমর্থন দেয়।
তাইওয়ানকে অর্থনৈতিক এই জোটে না নেওয়ার বাস্তবসম্মত কারণ রয়েছে। তাইওয়ানের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রশ্নটি শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশটির প্রধান মিত্র জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণ করার সুযোগ তারা দিতে চায় না। এর কারণ অর্থনৈতিক। কেননা তাইওয়ান অত্যাধুনিক সেমি–কন্ডাকটার পণ্যের ভান্ডার। তাইওয়ানকে যদি চীন নিজের সঙ্গে যুক্ত করার অজুহাত পেয়ে যায়, তাহলে প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। বাইডেনের সফরে আইপিইএফ গঠনের যে উদ্যোগ, তাতে এটা স্পষ্ট যে এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন আর শুধু নিরাপত্তানীতির জন্যই প্রাসঙ্গিক নয়, অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
বাইডেন যখন এশিয়ার বাজারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, সি চিন পিং তখন বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় দাবার বোর্ডে নিজের চাল বদল করছেন। চীন এত দিন ধরে বিশ্বে তার অর্থনৈতিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠাকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করত। এখন সেটা দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সি চিন পিং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রতাপ রক্ষা করতে গেলে সামরিক দিক থেকেও প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সম্প্রসারণের সঙ্গে কোয়াড ও ইন্দো–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জোটগত শক্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর বিপরীতে গত এপ্রিলে সি চিন পিং নতুন গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। গত মাসে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রধান একটি আলোচ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সুতরাং নতুন একটি নিরাপত্তা জোট গঠন করতে চান সি চিন পিং।
জো বাইডেন এবং সি চিন পিং—দুজনের কেউই এখনো জেতেননি। কিন্তু বিশ্ব দাবার বোর্ডে তাঁরা তাঁদের চাল চেলে যাচ্ছেন। আর তাঁদের দাবার বোর্ডে রানি ইউরোপ নয়, এশিয়া।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
অ্যালিসা গার্সিয়া হেররো ইউরোপীয় থিঙ্কট্যাংক ব্রুগেলের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো