সিঙ্গাপুর যে কারণে ধনী আছে এবং থাকবে

প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র‌্যাঙ্কিংয়ে সিঙ্গাপুর যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে

‘এশিয়ার চার বাঘ’ খ্যাত দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছে হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র‌্যাঙ্কিংয়ে সিঙ্গাপুর যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজনেস স্কুল আইএমডির র‌্যাঙ্কিং এমনটা জানাচ্ছে। একেকটি দেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং নাগরিকদের কল্যাণ কর্মসূচি বৃদ্ধির পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পারছে, তা বিশ্লেষণ করে এ ক্রম সাজানো হয়ে থাকে।

র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের উঠে আসার পেছনে দেশটির উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অনুকূল অভিবাসন আইন এবং নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ কাজ করেছে। প্রশ্ন হলো সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ অর্থনৈতিকভাবে এত উচ্চতায় উঠে এল কীভাবে? একজন বিদেশি যিনি কিনা দুই বছরের বেশি সময় সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছেন, তাঁর (এই ব্যক্তি লেখক নিজেই) বিবেচনায় দেশটির এই সাফল্যের পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, তা নিম্নরূপ:

ভৌগোলিক অবস্থান: বাণিজ্য-কৌশলগত দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক মাঝখানে সিঙ্গাপুরের অবস্থান হওয়ায় দেশটি আশপাশের দেশগুলোর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ধরা যাক মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলবাহী জাহাজ পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যাবে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম পথ পাড়ি দিতে সে জাহাজকে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে আসতে হবে। এই জাহাজকে পুরো পথ পাড়ি দিতে হলে মাঝপথে থেমে জ্বালানি নিতেই হবে। আর সেই মাঝপথে থামার সবচেয়ে ভালো বন্দরটি হলো সিঙ্গাপুর।

স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ: সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দলটি হলো পিপলস অ্যাকশন পার্টি। ১৯৫৪ সালে একটি ছাত্রসংগঠন থেকে স্বাধীনতাপন্থী এ দলের জন্ম হয়েছিল।

দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি টানা তিন দশক সরকারপ্রধান ছিলেন। এক প্রজন্মেই সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে তুলে আনার জন্য তাঁকে জাতির স্থপতি বলা হয়। লি কঠোরভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে একদলীয় শাসন ধরে রেখেছিলেন। স্থিতিশীল একদলীয় শাসন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছিল।

মহাপরিকল্পনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর জন্য ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর সেই পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পর্ষদে পর্যালোচনা হতো। ধীরে ধীরে সেই মহাপরিকল্পনাকে দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের মেধাবী তরুণদের মধ্যে অনেকেই সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যান। বৃত্তিপ্রাপ্তির শর্ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে তাঁদের দেশে ফিরে নির্দিষ্ট কয়েক বছর সরকারি চাকরি করতে হয়।

এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য যে কত জরুরি, তা বোঝাতে দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেখানে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগের সরকারের নীতি থেকে পুরোপুরি সরে নতুন নীতি প্রবর্তন হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন ক্ষমতায় আসার পর দেশটির আগের সরকারের স্থাপিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিষ্ক্রিয় করতে কয়েক বছর লেগেছে। যে শিল্প গড়ে তুলতে কয়েক দশক লেগে গেছে, তা সরকার পরিবর্তনের পর ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। রাজনৈতিক দোলাচলে দেশটিকে এ ধরনের বড় ধাক্কা খেতে হয়েছে।

অবস্থানগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত আরেক বন্দরভিত্তিক দেশ হংকংয়ে মাঝেম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। শুধু এই অস্থিরতার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত হয়।

সরকারি খাতে দক্ষ জনবল: সিঙ্গাপুরের মেধাবী তরুণদের মধ্যে অনেকেই সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যান। বৃত্তিপ্রাপ্তির শর্ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে তাঁদের দেশে ফিরে নির্দিষ্ট কয়েক বছর সরকারি চাকরি করতে হয়। এ ছাড়া দক্ষ সরকারি কর্মীদের উচ্চ বেতন দেওয়া হয়। সরকারের আর্থিক সাফল্যের অনুপাত অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের বোনাসও দেওয়া হয়। এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও কোনো সরকারি কর্মচারী দুর্নীতি করলে তাঁকে কঠোর সাজা দেওয়া সরকারের পক্ষে নৈতিক দিক থেকে সহজ হয়।

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ: তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক গ্রহণের জন্য সিঙ্গাপুরের সুনাম দুনিয়াজোড়া। এ ছাড়া বহু খাতে তারা ট্যাক্স নেয় না। লভ্যাংশ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ এবং উপহার–উপঢৌকন পাওয়া কোনো কিছুর ওপর সেখানে শুল্ক দিতে হয় না। সোনা-রুপার কেনাবেচায় পর্যন্ত ট্যাক্স আরোপ করা হয় না। এ বাধাহীন লেনদেনের কারণে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

সিঙ্গাপুরের বাস ও পাতালরেলসহ সব ধরনের সরকারি পরিবহনব্যবস্থা শুধু সর্বাধুনিক নয়, বিস্ময়কর বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় এসব পরিবহনে যাতায়াত ও মালামাল আনা–নেওয়া অনেক সস্তা। অন্যদিকে, সেখানে প্রাইভেট কারের মালিক হওয়া অনেক কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ায় যে গাড়িটির যত দাম, সিঙ্গাপুরে তা কিনতে গেলে তার চার গুণ টাকা খরচ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি কম থাকায় সেখানে গণপরিবহন চলাচল সহজ হয়েছে।

এসব বিষয় সিঙ্গাপুরকে ধনী করেছে। যত দিন এসব নীতি আছে, তত দিন দেশটি ধনীই থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত l

জুন ইয়ুথ কাওন দক্ষিণ কোরীয় লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক