রাজনৈতিক কিংবা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, চট্টগ্রামের সব মত, আদর্শের মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়েছে সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) ঘিরে। শহরের কোনো বিষয় নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব শ্রেণির মানুষের এমন সরব হয়ে ওঠার নজির চট্টগ্রামে বিরল। এটি এখন নাগরিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। কয়েক মাস ধরে করোনাকালের এই দুঃসহ সময়ে মানুষ সবকিছু ভুলে সিআরবির ঐতিহ্যকে রক্ষার আন্দোলনে প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। সিআরবির ঐতিহ্য রক্ষা মানে এর পরিবেশকে রক্ষা করা, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অক্ষুণ্ন রাখা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে লালন করা, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে ইতিহাসের নানা ঘটনার স্মৃতিকে ধরে রাখা। প্রাচীন পর্যটক ও ঐতিহাসিকেরা যে চট্টগ্রামকে ‘অত্যুচ্চ শৈলপ্রাচীর মণ্ডিত, হরিদ্বর্ণ বৃক্ষরাজি-সুশোভিত’ বলে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সামান্য স্মৃতিচিহ্ন সিআরবিকে আঁকড়ে ধরার অংশ হিসেবে এই আন্দোলন।
নগরায়ণের অপরিণামদর্শী উন্নয়নে প্রকৃতির অনেক দান হারিয়ে ফেলে চট্টগ্রাম আজ নিঃস্ব। করোনার ভয়াবহ আক্রমণে আক্রান্ত ফুসফুসের জন্য মানুষের যে রকম অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, পরিবেশে, ইতিহাস বাঁচাতে সিআরবির প্রাকৃতিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখা দরকার। এই জন্যই চট্টগ্রামের মানুষ সিআরবিকে ‘চট্টগ্রামের ফুসফুস’ আখ্যা দিয়েছে। পরিবেশগতভাবে মুমূর্ষু চট্টগ্রামের মানুষ তাদের ফুসফুসকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাবে বলে অঙ্গীকার করেছে।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন টাইগার পাস লাগোয়া পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ১৮৭২ সালে নির্মিত বন্দরনগরীর প্রাচীনতম ভবন সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিংকে (সিআরবি) ঘিরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সহজে থামবে বলে মনে হয় না। করোনাকালের এই সময়ে শত শত মানুষ যেভাবে সিআরবিতে জড়ো হচ্ছে, তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় স্বাভাবিক সময়ে এই আন্দোলনের বাহ্যিক আকার কত বিশাল হতো। কেননা এ এলাকার সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি আছে, এখানে রয়েছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রবের বাসভবন। যেসব মানুষ সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন, যাঁরা এর ছায়ার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন, ভোরবেলা প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে সুস্থ থাকেন, বিকেলে যাঁরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে ঘুরতে আসেন, যাঁরা পয়লা বৈশাখে এখানে দিনভর নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন করেন, যাঁরা ১৮৯৯ সালে তৈরি বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিনের মডেল দেখে এ দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারেন, বহু গম্বুজসংবলিত মসজিদ দেখে যাঁরা মুগ্ধ হন, সিআরবি ভবনের প্রাচীন ঐতিহ্য ভালোবাসেন, পাহাড়ের শীর্ষে হাতির বাংলোর পাশে দাঁড়িয়ে পুরো চট্টগ্রাম শহরকে একনজর দেখতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা কখনো এই এলাকার প্রকৃত কাঠামো ভেঙে হাসপাতাল করতে দেবেন না।
এই জন্যই কবি, সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘শুধু গাছপালা নয়, সিআরবির পুরো এলাকাটাই রক্ষা করা দরকার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন এখানে। আমাদের সংবিধানে ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান রক্ষার কথা বলা আছে। সিআরবির বেলায় তা প্রযোজ্য। তা ছাড়া এই এলাকাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক বলয়। তাই এটিকে ধ্বংস করা যাবে না। সিআরবি এলাকায় রেলের একটি হাসপাতাল আছে। অকেজো পড়ে আছে। সেটিকে নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে চালু করা যেতে পারে।
কোনো বাণিজ্যিক হাসপাতাল নয়, পিপিপি মানের জনগণের টাকা, তা দিয়ে ধনীদের জন্য হাসপাতাল করার কোনো যুক্তি নেই।’ আবুল মোমেনের মতো অধ্যাপক অনুপম সেনও বলেছেন, ‘প্রয়োজনে অনশনে যাব, তবু ওখানে হাসপাতাল হতে দেব না। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতিসচেতন, মানুষের কথা ভাবেন। ঠিকমতো খবরটা পৌঁছাতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবেন। এ শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আগের মতো নেই। একসময় পরির পাহাড়, বাটালি পাহাড়, সিআরবি পাহাড়ের উঁচুতে উঠে এই নগরের অপরূপ যে প্রকৃতি দেখা যেত, তা এখন আর দেখা যায় না। তাই সিআরবিকে কিছুতেই ধ্বংস করা যাবে না। এখানে রয়েছে শত বছর পুরোনো অনেক গাছ। সিআরবি মহানগরের শ্বাসকেন্দ্র। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবের বাসাও এখানে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘চট্টগ্রামের সব মানুষ এই দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটি রক্ষায় এখন এক হয়েছে, তাতে যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারাও। চট্টগ্রামের স্বার্থে এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে সবাই।’
সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনার প্রতিবাদ শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওখানে হাসপাতাল হলে পরিবেশ ও ঐতিহ্যের কী হতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন অনেকে। সেগুলোর শেয়ার হয়েছে অসংখ্য। অনেকে পোস্টার করেছেন, স্লোগান লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সিআরবির ব্যাপারে মানুষের মতামত বোঝা গেছে ভার্চ্যুয়াল জগতেই। কিন্তু সেই জনমতের তোয়াক্কা করেন না হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোক্তারা। তাঁরা নির্বিকার। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ভার্চ্যুয়াল জগৎ ছাড়িয়ে সিআরবির মাটিতে নেমেছে। প্রথমে কেউ কেউ এককভাবে, দল বেঁধে, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। এমনও দেখা গেছে একই সময়ে একাধিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যে যেভাবে পারে, নানা ক্ষেত্র থেকে, নানাভাবে এর প্রতিবাদ হয়েছে।
তবে এই আন্দোলনের এখন একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। ‘নাগরিক সমাজ আন্দোলন’-এর ব্যানারে চট্টগ্রামের সব মানুষ এখন এক হয়েছে। এই কমিটির চেয়ারম্যান অনুপম সেন। সদস্যসচিব প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন বাবু। কো-চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, শহীদজায়া লেখক বেগম মুশতারী শফী, শিশুসংগঠক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে। এই কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব কামরুল হাসান জানান, চট্টগ্রামবাসীর দাবির এই কথা জানিয়ে ইতিমধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি পাঠিয়েছে। বর্তমানে এই দাবির পক্ষে তাদের গণস্বাক্ষর অভিযান চলছে। এতে চট্টগ্রামবাসী ব্যাপকভাবে সাড়া দিচ্ছে।
কয়েক মাস ধরে সিআরবিতে বিভিন্ন আবৃত্তি অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, মূকাভিনয়, প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, গানের অনুষ্ঠান, একক অভিনয়সহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে এখানে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে। চট্টগ্রামের গণমাধ্যমগুলোও এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছে। একটা দাবির জন্য চট্টগ্রামের শ্রেণি, পেশা, দল নির্বিশেষে যেখানে এক হয়েছে। সবাই একমত, সিআরবিতে হাসপাতাল করা যাবে না। অথচ মানুষের এই মতামতকে অগ্রাহ্য করে, সব মানুষের দাবির কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলেছেন, সিআরবিতে হাসপাতাল হবে এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর এই বক্তব্য জাতীয় স্থানীয় অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে চট্টগ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এই আন্দোলনের নেতারা তাঁর প্রতি সংযত আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু মানুষ এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন মানুষের সেবা করার জন্য। এ কারণে তাঁদের জনসম্পৃক্ত থাকতে হয়। এই সম্পৃক্ততা না থাকলে তাঁরা দেশ ও দশের বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যান। তাঁরা যদি মনে করেন, মানুষের দাবিকে অগ্রাহ্য করে রেলের প্রশাসন চলবে, দেশ চলবে তাহলে তিনি ভুল করবেন। মানুষের প্রাণের কথা, অভিমতকে অগ্রাহ্য করে শুধু রেল নয়, কোনো কিছুই বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। তাই সিআরবির উদ্যানে কুঠারের আঘাত পড়ার আগে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে, এই প্রত্যাশাই এখন চট্টগ্রামবাসীর।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।