সালমান: পাকিস্তানের অসময়ে যুবরাজের চমক!
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যেন চমক দেখাতেই ভালোবাসেন! পৌনে দুই বছর আগে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশটির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার পর নানা চমক ‘উপহার’ দিয়েছেন তিনি। হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত। এবার তিনি চমকে দিলেন পাকিস্তানিদের।
যুবরাজ সালমান রাষ্ট্রীয় সফরে শনিবার রাতে পাকিস্তানে পৌঁছানোর কথা ছিল। সেই অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক হয়। সৌদি আরব থেকে পাঁচ ট্রাক ‘মালামাল’ পৌঁছে যায় পাকিস্তানে। সৌদি যুবরাজের সফর সামনে রেখে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয় ইসলামাবাদে। যুবরাজকে বরণ করতে যখন পাকিস্তান প্রস্তুত, তখনই নতুন খবর এল; শনিবার নয়, যুবরাজ পাকিস্তানে পৌঁছাবেন আজ রোববার। কিন্তু রোববার থেকে তাঁর সফরের পূর্বনির্ধারিত সূচি অপরিবর্তিত থাকবে। যুবরাজের ইচ্ছামতো সূচি ঠিক রাখতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের একটি বৈঠক বাতিল করা হয়।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর খবরে বলা হয়, যুবরাজের সফর কাটছাঁটের বিষয়টি পাকিস্তানকে আচমকা জানানো হলেও এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার পর এটাই যুবরাজের প্রথম পাকিস্তান সফর। পাকিস্তানিদের জন্য সৌদি যুবরাজের আরও কোনো চমক আছে কি না, তা আজকালের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। যুবরাজের এই সফরে ৭০০ কোটি ডলারের সৌদি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে ইমরান খানের পাকিস্তান। সেই বিনিয়োগ হবে দুই বছরের মধ্যে হবে বলে প্রত্যাশা ইসলামাবাদের।
গত বছরের আগস্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইমরান দেখেন রাজকোষ প্রায় শূন্য। বিদেশি সহায়তা পেতে মরিয়া ইমরান পাকিস্তানের বেশির ভাগ প্রধানমন্ত্রীর মতো তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিলেন সৌদি আরবকে। সৌদি আরবও তাঁকে নিরাশ করেনি। ৬০০ কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ দিয়েছে ইমরানকে। গত সেপ্টেম্বরে ইমরানের ওই সফরের সময় সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে জেরবার সৌদি। রিয়াদে আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলন তখন হুমকির মুখে। ইমরান সহায়তা প্যাকেজ পেয়ে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসিতে ওই বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিলেন; খাসোগি হত্যায় সৌদি যুবরাজের সম্পৃক্ততা নাকচ করে দিয়ে দাঁড়ালেন তাঁদের পাশে।
সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কটাই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসি-নির্ভর। ২০০৪-২০১৫ সাল পর্যন্ত সৌদি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাওয়াফ ওবাইদ। তিনি সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘সৌদি আরব পাকিস্তানকে সব সময় সহায়তা করে, কারণ ইসলামাবাদকে সবল-তরতাজা দেখতে চায় রিয়াদ...কাগজ-কলমে বা নথিপত্রে উল্লেখ না থাকলেও দুই দেশের মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে, সেটা হলো কূটনৈতিক, নিরাপত্তা বা সামরিক ইস্যুতে সব সময় পাকিস্তানকে পাশে চায় সৌদি আরব।’
ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তান সৌদি সহায়তা নিলেও সব সময় যে সৌদির চাওয়া পূরণ করেছে, তা নয়। যেমন ২০১৫ সালে ইয়েমেনে ইরানপন্থী হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে পাকিস্তানকে চেয়েও পায়নি সৌদি। কারণ ইরান-সৌদি ইস্যুতে ‘নিরপেক্ষ’ থাকতে চেয়েছে পাকিস্তান। সেটা ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে। তবে অন্যতম সহায়তাকারী দেশটিকে পুরোপুরি নিরাশও করেনি ইসলামাবাদ। তাদের সাবেক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম’ প্রধান হওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
সম্পদশালী দেশ সৌদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে চাপে রাখতে সব সময় পাশে চায় পাকিস্তানকে। আর সেটা জেনেই পাকিস্তানিরা বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে রিয়াদের কাছ থেকে। তারপরও ইরান-সৌদি সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নীতি পাকিস্তানের। ইমরান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের ইসলামাবাদ সফর যেন সেটাই প্রমাণ করে। জাভেদ জারিফই প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি প্রধানমন্ত্রী ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে তেহরান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ইমরানের সৌদি সফরের সময় খাসোগি হত্যায় যুবরাজ সালমান ছিলেন কঠিন চাপে। এখন যুবরাজ যখন ইসলামাবাদ সফর করছেন, তখন ইমরান খান চাপে! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভয়াবহ হামলায় ৪৬ ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়েছে নয়াদিল্লি। এর পরিণতি হিসেবে পাকিস্তানকে ‘পুরোপুরি একঘরে’ করারও ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর ভারতের সঙ্গে সৌদি সম্পর্ক দিন দিন জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০৬ সালে সৌদি বাদশাহর নয়াদিল্লি সফরের পর সৌদি-ভারত সম্পর্ক গতি পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সফর শেষ করেই দুদিনের ভারত সফরে যাচ্ছেন যুবরাজ সালমান। এ বিষয়টিই আলাদা করে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে পাকিস্তানের কপালে।
শুধু ভারত নয়, ইরানের দিক থেকেও চাপে পড়েছে পাকিস্তান। কয়েক দিন আগে ইরানের এলিট ফোর্স রেভল্যুশনারি গার্ডের ওপর হামলায় ২৭ জন নিহত হন। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘ইনডিপেনডেন্ট’ জানিয়েছে, এই হামলার দায় স্বীকার করেছে সুন্নি সংগঠন জয়েস আল-আদল। পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে জঙ্গিবাদী এই সংগঠনটির যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে তেহরান এখন সন্দেহের দৃষ্টি ফেলেছে ইসলামাবাদের ওপর।
ভারত-ইরানের এই চাপের সময় সৌদি যুবরাজের সফরকে পাকিস্তান কীভাবে কাজে লাগায়, সেটাই দেখার বিষয়। ২২ গজের ক্রিকেট পিচে চমক দেখানো ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ছিল যেমন চমক, তেমনি রক্ষণশীল সৌদিতে ফ্যাশন-গাড়ি চালানোতে নারীদের অনুমতি দেওয়া, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী-প্রিন্সদের বন্দী করাসহ নানা চমক দেখিয়েছেন যুবরাজ সালমান। অনেকটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইমরান-যুবরাজের মুখোমুখিতেও কি নতুন কোনো চমক থাকছে?
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]