সার্কের যাত্রাপথ

সার্ক
সার্ক

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রথম চিন্তা কবে কার মনে জেগেছিল, তা বলা দুষ্কর, তবে আমরা জানি যে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজভবনে তাঁকে প্রদত্ত একটি ভোজসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে যদি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সৃষ্টি করতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। 
১৯৮০ সালের মে মাসে এই ঢাকা থেকেই গিয়েছিলেন আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বার্তা হাতে কজন বিশেষ দূত। ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, নেপালের কাঠমান্ডু, ভুটানের থিম্পু, শ্রীলঙ্কার কলম্বো আর মালদ্বীপের মালেতে সেদিন পৌঁছেছিল ঢাকার উদাত্ত আহ্বান। সহযোগিতার সময় এসেছে। আসুন, আমরা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সহযোগিতায় সচেষ্ট হই—যেমনটি হয়েছে বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চল। আসুন, আমরা নিজেদের মাঝে বিদ্যমান সন্দেহ আর অবিশ্বাসের সমাপ্তি টানি, এই সন্দেহ আর অবিশ্বাস সাম্রাজ্যবাদীদেরই সৃষ্টি। আসুন, আমরা আমাদের এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে প্রয়াসী হই, কারণ অগ্রগতির জন্য শান্তি অপরিহার্য।
রাজনীতির পঙ্কিল পথে এই আহ্বানের অগ্রযাত্রা প্রায়ই রয়েছে কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে সার্কের সেই প্রারম্ভের দিনগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির বিবর্তন কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবে সার্কের উদ্বোধনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। সার্কের কোনো সেক্রেটারিয়েট তখন ছিল না, তাই স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল, তাই বোধ করি প্রতিটি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ওপর আমার একটি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।
২৬-২৭ নভেম্বরে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত অষ্টাদশ সার্ক সম্মেলনে একটি বাড়তি আগ্রহের বিষয় ছিল তাতে প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগদান। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কের সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সার্ক সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ আগ্রহই প্রকাশ করেছিলেন। এটা স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অঞ্চলে ভারতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। কারণ, তাহলেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজতর হবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। তা এই সার্ক সম্মেলনে কতটুকু প্রতিফলিত হবে, তাই ছিল দেখার বিষয়। ১৮তম সার্ক সম্মেলনের প্রথম দিনে তো মনে হয়েছিল এবারকার সার্ক না মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। রেল চুক্তি, মোটরযান চুক্তি এবং বিদ্যুৎ চুক্তি কোনোটারই অগ্রগতি হচ্ছিল না। সম্মেলনের দ্বিতীয় অর্থাৎ অন্তিম দিনেই বিদ্যুৎ চুক্তি অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলো। এতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসমেত সার্ক সরকারপ্রধানদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহই প্রতিফলিত হয়।
গত ২৯ বছরে শম্বুকগতিতে হলেও সার্কের অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি। এটা অবশ্য সত্যি যে আমাদের নিয়ে সার্ক তার যে যাত্রা শুরু করেছিল, তা অতীতে সব সময় বজায় রাখা দুষ্কর হয়েছে। সার্ক নিয়ে এই আশা ছিল যে উন্নততর পরিবেশ সৃষ্টি করে সার্ক সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির সহায়ক হবে। ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ঘটেছে বলে বলা যাবে না। তাদের সম্পর্ক যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়েই গেছে।
তবে সার্ক ইতিমধ্যেই এই সংস্থার সদস্যরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে যত ধীরেই হোক না কেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি সম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রয়াস নিচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত বিদ্যুৎ চুক্তি সেগুলোর একটি। সার্কের বর্তমান আটটি সদস্যদেশের মানুষ যদি তাতে মৈত্রীর বন্ধন খুঁজে পায় তাহলেই সার্ক কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যাবে। তাহলেই এই অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে তা আশানুরূপ একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
[email protected]