জুন ২৯, ২০১৪-এর ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, টি- েটায়েন্টি বিশ্বকাপের সময় নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১১৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সে সময়ে প্রায় ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার রাস্তার পাশে নানা রঙের আলোকসজ্জা, রাস্তার পাশে দেয়াল রংকরণসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তখন রোড ডিভাইডারগুলোয় রান্নাঘরের কিংবা টয়লেটের চকচকে টাইলস ব্যবহার করার কারণে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউশন মাঠে নামে এবং বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়। গত মার্চ মাসে দেখা গেল, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে জাহাঙ্গীর গেট থেকে কাকলী-বনানী সংযোগ রাস্তা পর্যন্ত কংক্রিটের রোড ডিভাইডার ভেঙে সেখানে সবুজায়ন করার প্রকল্পের কাজ চলছে, আসলে কতটুকু সার্থক হয়েছে, সেটি একবার চোখে দেখলেই বোঝা যায়।
আমাদের দেশে, বিশেষ করে শহরগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ কিংবা বড় ধরনের অনুষ্ঠান, খেলাধুলা কিংবা কারও আগমনে নগরকে আলো-ঝলমলে করে সাজাতে, নগরের শোভাবর্ধনে সবুজ গাছ লাগাতে, হার্ডেবার্ড দিয়ে কিছু একটা তৈরি করে রাস্তার মাঝখানে বসাতে ইত্যাদি। এসব করে ক্ষণিকের জন্য নগরকে চকচকে মনে হয় কিংবা রঙিন মনে হলেও এগুলো শুধু কোটি কোটি টাকা অপচয়ের শামিল। কারণ, ক্ষণস্থায়ী এ কার্যক্রমগুলোর জন্য নগরকে অপরিকল্পিতভাবে সাজানোর জন্য কী পরিমাণ অর্থ, বিদ্যুৎ আর শ্রম ব্যয় হচ্ছে প্রতিবছর আমাদের দেশে, যার কোনো মাপকাঠি নেই।
২০১১ সালের আইসিসি ক্রিকেট কাপ কিংবা কোনো বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান উপলক্ষে অথবা বিশেষ কারও আগমন উপলক্ষে নগরের রাস্তাঘাট আলোকিত করা হয় দু-চার দিনের জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য প্লাস্টিকে নির্মিত কৃত্রিম গাছ কোটি টাকা খরচ করে রাস্তার আইল্যান্ডে বসাতে। চকচকে হবে দেখে রাস্তার কোনো দেয়ালে চকচকে টাইলস, হোক সেটা রান্নাঘর কিংবা টয়লেটের, মোড়ে কৃত্রিম জলপ্রবাহ বা ঝরনা, ব্যানার-ফেস্টুন ইত্যাদি রাস্তায় নামলেই চোখ এড়ায় না। সেগুলোর স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক দিনের। অথচ যে রাস্তার পাশের দেয়ালে কৃত্রিম গাছ বসানো হয়েছে, ঝরনাপ্রবাহ চলছে দু-চার দিনের জন্য, দেখা যায় তার পাশের রাস্তাটি একেবারেই চলাচলের অযোগ্য। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এগুলোর করুণ অবস্থা দেখতে হয় সাধারণ নাগরিককে। অন্যদিকে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের ইচ্ছায় কিংবা সিদ্ধান্তে কৃত্রিম চোখ ধাঁধানো অপরিকল্পিত আলোকসজ্জা, যা বিদ্যুতের অপচয় করছে অনবরত। অপরিকল্পিত সবুজায়ন হয়ে আসছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বছরের পর বছর। বিশেষ করে, ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় বের হলে এই দৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে আসলে যা হচ্ছে, সেটি হলো একধরনের অপরাধ কিংবা নগরকে আরেক ভবিষ্যৎ অপরিকল্পনার দিকে ঠেলে দেওয়া।
আমরা সব সময় ক্ষণস্থায়ী বিষয়বস্তুর ওপর ঝুঁকি প্রদর্শন করে থাকি। নগরের সৌন্দর্যবর্ধন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেটি যদি হয় পরিকল্পিত কিংবা স্থায়ী কোনো সমাধান, তাহলে কোটি টাকার অর্থ, যা কিনা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আসে, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার ঘটবে। চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একদল ছাত্রছাত্রীকে কিছুদিন আগে একটি সমীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের শিক্ষা কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম শহরের ওপর। সেখানে তাঁরা শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট, রোড, জংশন, কাঁচাবাজার ইত্যাদি স্থানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, সদিচ্ছা, পরিকল্পনার অভাব, হঠকারিতা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব, অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমরা আমাদের পাবলিক স্থান (যেখানে সাধারণ মানুষ সহজে যাতায়াত করতে পারে) দিনের পর দিন নষ্ট করে তুলছি।
তাঁরা দেখেছেন, রাস্তার নোড পয়েন্টে যদি সুন্দর সবুজ পার্ক করা যায় এবং এর চারপাশে যদি হাঁটার রাস্তা করা যায়, তাহলে সেখানকার পাবলিক মুভমেন্ট ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, রাস্তার মোড়গুলোর চারপাশ থেকে যদি সত্যিকার অর্থে খানিক সবুজ রেখে দেওয়া যায়, সেখানে সাধারণ মানুষজন একটু বসতে পারে। তাহলে স্থানগুলোর ভূমিকা সমাজজীবনে অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ এসব বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি না দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে যা করছে, তাকে দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ, শহরের রাস্তার ফুটপাতে যখন মানুষ হাঁটে না, তখন ফুটপাতগুলো হয়ে থাকে নোংরা। সেই রাস্তায় যখন কৃত্রিমভাবে সিমেন্টের তৈরি টবে গাছগুলো লাগানো হয়, কিংবা দেখা যায় বৈদ্যুতিক বাতিগুলো যখন কৃত্রিমভাবে বিদ্যুৎ খরচ করে সামনে চরকি ঘোরাতে থাকে, তখন সত্যিই মনে হয় আমাদের দেশে কি কেউ আছে এগুলো দেখার জন্য৷ কোনো পেশাদার সৃজনশীল গোষ্ঠী, যারা শুধু নগরের সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করবে কিংবা থাকলেও সরকারের সঙ্গে কাজ করার কোনো ক্ষেত্র কিংবা সুযোগ তৈরি করা হয়েছে কিংবা করার মতো সামর্থ্য আর সদিচ্ছা আছে কি না?
তাই আমরা যদি সাময়িক রংঢং আর কৃত্রিমতাকে পরিহার করে স্থায়িত্ব নিয়ে ভাবি, লোক দেখানো কোটি টাকার প্লাস্টিকের গাছ আর সিমেন্টের টব না বসিয়ে সেখানে পরিবেশের কথা চিন্তা করে স্থায়ী কোনো কিছু নিয়ে ভাবি, তাহলে আস্তে আস্তে আমাদের শহরগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আর প্রতিবছর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন উপলক্ষে দেশের অর্থভান্ডার থেকে অযথা অর্থের অপচয় হবে না। এ জন্য দরকার অপরিকল্পিত সৌন্দর্যবর্ধন না করে ভিজ্যুয়াল মাস্টারপ্ল্যান করে ধীরে ধীরে সামর্থ্য ও অর্থায়ন অনুযায়ী এক-একটা একবারে শেষ করা। কারণ, কোনো কাজ অর্ধেক শেষ করে পরে হবে, এই বলে ফেলে রাখলে সেটি আর কখনো করা হয়ে ওঠে না এবং পরবর্তী সময়ে সে স্থান নগরের সৌন্দর্যহানি ঘটাবে, এটাই স্বাভাবিক।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
[email protected] <mailto:[email protected]>