অনেকে বলতে ভালোবাসেন যে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও এ দেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ; কিংবা আরও আগবাড়িয়ে কেউ কেউ বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এ দেশে নিরাপদে আছে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উৎসব হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে উপভোগ করে। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে এসব ভাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দুই দফা আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ এর নিকৃষ্ট উদাহরণ।
যেখানে সব ধর্মের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, হিন্দু জনসংখ্যা ১০ লাখ কমেছে; নিজ ভূমির মায়া ত্যাগ করে তারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এটা হয়েছে ‘ফোর্সড মাইগ্রেশন’ বা ‘জবরদস্তিমূলক অভিগমন’-এর কারণে। বিগত কয়েক বছরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, হামলা-মামলা, তাদের জায়গা-জমি দখল যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। রামুতে বৌদ্ধমন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া, পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা, নওগাঁয় চারজন সাঁওতাল কৃষককে হত্যা করা, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির উচ্ছেদের চেষ্টা, চিরিরবন্দরে হিন্দু উপাসনালয়ে আক্রমণ, পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতকে হত্যা—এ রকম বহু নজির আমাদের স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলতে গিয়ে অনেকে ইতিহাসকে সাক্ষী মানেন যে যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমরা শান্তিতে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ভারত-পাকিস্তান ভাগই হয়েছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, যার মূল কথা ছিল হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি (যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই), তাদের আর একসঙ্গে থাকা চলে না। ভারত ভাগ নিয়ে হিন্দু, মুসলিম আর শিখ ধর্মের মানুষেরা ইতিহাসের ভয়ংকরতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মেতে উঠেছিল। কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার আর পাঞ্জাবের এসব দাঙ্গায় কমপক্ষে ১২ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা পাকিস্তানেও চলেছে। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ দাঙ্গার কথা আমরা জানি, দাঙ্গার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছিল, বহুসংখ্যক হিন্দু মানুষ তখন দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জেতার পর দেশের হিন্দু নারী-পুরুষের ওপর যে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন নেমে এসেছিল, তা নিশ্চয়ই কেউ ভোলেনি। তখনো অনেক হিন্দু দেশ ছেড়েছিল। এখনো সেই ধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে বলা যাবে না।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আহমদিয়া জামাত কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, হাজংসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমিজমা দখল হয়ে যাচ্ছে; সত্য যে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি—এর কারণ ‘দাঙ্গা’ বা ‘রায়ট’ শব্দের মানে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি, যাকে বলে রক্তাক্ত ভায়োলেন্স। স্বাধীন বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা হচ্ছে একপক্ষীয় সন্ত্রাস। অর্থাৎ, এখানে সংখ্যাগুরু মুসলিমরা সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের একতরফা আক্রমণ করেছে, সংখ্যালঘুরা কোনো পাল্টা আক্রমণ বা প্রতিরোধ করতে পারেনি। কাজেই অন্যরা বাংলাদেশে কোথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখলেন, তা বোধগম্য নয়। আমি বরং বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে একমত। বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ রয়ে গেছে।’ কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবলই এক ‘মিথ’—বাস্তবে বা নিকট অতীতে যার প্রমাণ আমরা দেখি না। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান দেখে বহুমুখী লেখক হুমায়ুন আজাদ আশির দশকে খেদোক্তি করেছিলেন এই বলে যে আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ জীবন অতিবাহন করছি; আর বর্তমান বাংলাদেশ দেখে প্রতীতি জন্মাচ্ছে, ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারালো চাপাতির নিচে’ আমরা এখন জীবনোপায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
হুমায়ুন আজাদ নিজেও কোপের শিকার হয়েছিলেন—তাঁরই উপন্যাসের মতো জঙ্গিরা তাঁকে চাপাতি দিয়ে ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদে’ পরিণত করেছিল। সত্য বটে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সমান্তরালে চাপাতির কোপও বাড়ছে। মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী সুলতানা কামাল যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, জীবনের নিরাপত্তা যদি না থাকে, কী করব এই প্রবৃদ্ধি-জিএনপি-জিডিপি দিয়ে? কী লাভ পার-ক্যাপিটা-ইনকামের হিসাব কষে? কথা তো ঠিক। আমরা যে ধর্মাবলম্বীই হই না কেন, প্রতিক্রিয়াশীলের চাপাতির কোপের রেঞ্জের বাইরে কেউ-ই নই। টার্গেট যেন সবাই! সবার নামেই মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা আছে। এ যেন ‘জন্ম মানেই আজন্ম মৃত্যুদণ্ড বয়ে বেড়ানো’।
সংখ্যালঘুদের জমিজমা-সম্পদরাজি দখলের জন্য প্রথমত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর; দ্বিতীয়ত, বসতবাড়িতে লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ; তৃতীয়ত, উপাসনালয় আক্রমণ এবং চতুর্থত, সংখ্যালঘুদের হুমকি-ধমকি-মামলা দেওয়া হয়; এসবে কাজ না হলে তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, যাতে সংখ্যালঘু মানুষের পক্ষে এলাকায় সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা আর সম্ভব না হয়; এর ফলে তারা হয় অন্যত্র নয়তো অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়।
সংখ্যালঘুদের জমি দখল বা তাদের ওপর আক্রমণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত—কেউই পিছিয়ে নেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে যারপরনাই এক অমানবিক, নিষ্ঠুর আর রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয়ে চলেছে। এই সাম্প্রদায়িক দখলবাজির প্রতিকারের জন্য কেউ নেই, নেই কোনো প্রতিবিধান। আর জঙ্গিবাদ? আমরা মনে করি, জঙ্গিবাদ এই সাম্প্রদায়িকতারই এক উগ্র রূপ ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’-এর নামে যে তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।