সামাজিক সম্পর্কটিও থাকবে না?

বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী
বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী

সম্প্রতি প্রবীণ বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মহিবুল হাসানের (নওফেল) হাসিমুখে করমর্দন ও কোলাকুলির একটি আলোকচিত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে এই ছবি। কেন এই ছবি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করল সংবাদমাধ্যম? কেনই–বা এটি আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি করল সাধারণ মানুষের মধ্যে?

আমাদের ধারণা, এই ছবির মধ্যে একটি বার্তা আছে, শুভ বার্তা। বর্তমান সময়ে কতটা সম্ভব, তা নিশ্চিত না হয়েও বলা যায়, মানুষের আশা এই শুভ বার্তাটি ছড়িয়ে পড়ুক দেশজুড়ে। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি আগেও প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। দুটি কারণে এ ধরনের ছবি গুরুত্ব পায়। প্রথমত, এ রকম দৃশ্য আমাদের দেশে সচরাচর দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, নেতাদের এই হাসি-আলাপের ছবি দেখে কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এ রকম ধারণা জন্মাতে পারে যে, দলীয় আদর্শের বিরোধ থাকা সত্ত্বেও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব। এমনকি সেটা নির্বাচনী যুদ্ধের এই স্নায়ুক্ষয়ী সময়েও।

১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-১০ আসনে বিএনপির প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান জেল রোড এলাকায় আমানত শাহ (রহ.)–এর মাজার জিয়ারত করে বের হচ্ছিলেন। একই সময়ে ওই পথ দিয়ে গণসংযোগে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম-৯ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী। জ্যেষ্ঠ নেতা নোমানকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিয়ে এগিয়ে যান নওফেল। কোলাকুলি ও কুশলবিনিময় করেন। নওফেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দোয়া করেন নোমান।

মনে হতে পারে, দুটি ভিন্ন আসনের প্রার্থী বলেই এই সৌজন্য রক্ষা হয়েছে। কিন্তু এ রকম সৌহার্দ্যের দৃশ্য তো কদিন আগেও আমরা দেখেছি একই আসনের (চট্টগ্রাম-১১) দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ ও এম এ লতিফের মধ্যে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে বিভাগীয় কমিশনারের কক্ষের সামনে এই দুজনের দেখা হয়ে গেলে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন। লতিফ বলেছেন, ‘আমীর খসরুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভালো। তিনি অবশ্যই একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।’

এম এ লতিফের সঙ্গে দেখা হওয়ার অব্যবহিত আগেই আমীর খসরুর দেখা হয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে। খসরু আঞ্চলিক ভাষায় কুশলবিনিময় করেছেন, ‘নাছির ক্যান আছ?’ নাছির বলেন, ‘ভালা আছি বদ্দা, দোয়া গইজ্জুন।’ পত্রপত্রিকায় যখন এসব ছবি ও কথোপকথন প্রকাশিত হয়, সাধারণ মানুষ তখন স্বস্তিবোধ করে, আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু এ রকম প্রীতিকর দৃশ্যের রেশ না ফুরাতেই আমীর খসরু যখন বিমর্ষ চেহারায় অভিযোগ করেন, তাঁর নির্বাচনী গণসংযোগে বাধা দিয়েছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা, তখন সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে যায়। সৌজন্য, সদ্ভাব, সম্প্রীতি শব্দগুলো তখন অর্থ হারায়। সজ্জন ও সুরুচিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পরিচিতি আছে আমীর খসরুর। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কখনো বিষোদ্গার করেছেন—এই অপবাদ তাঁর সম্পর্কে কেউ দিতে পারবে না। তাঁর দল বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকার সময়ও ‘পলিটিক্যাল ক্যাডার’ বা মাস্তানদের তিনি প্রশ্রয় দেননি। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা পান তাহলে ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’ বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।

শুরুতে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক নোমানের প্রতি নওফেলের শ্রদ্ধা ও সৌজন্য সম্পর্কে বলছিলাম। আসলে তাঁর পিতা চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীই এ অঞ্চলে ‘রাজনৈতিক বিরোধ’ ও ‘সামাজিক সম্প্রীতি’—এ দুটি বিষয়ের ভারসাম্য রক্ষার উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। যেমন রাজনীতির মাঠে নোমান ও মহিউদ্দিনের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। কর্ণফুলীর তৃতীয় সেতুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ ছিল তাঁদের। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে নোমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তাঁদের ‘মউ-ভাইনা’ (মামা-ভাগনে) সম্পর্ক ছিল বহুল আলোচিত। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ ও নগর বিএনপির এই দুই নেতার কারণেই এ অঞ্চলে দুটি দলের মধ্যে হানাহানি ও সংঘাত ছিল না বলে অনেকের ধারণা।

আবার নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁরা পাশাপাশি থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদে হামলার ঘটনায় এ দেশে যখন স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার উসকানি দিয়ে যাচ্ছিল, তখন নোমান ও মহিউদ্দিনের যৌথ নেতৃত্বে সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সর্বদলীয় সভা-সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে।

বিএনপির নেতা মীর নাছিরের সঙ্গে ছিল মহিউদ্দিনের অম্লমধুর সম্পর্ক। ১৯৯৪ সালে মেয়র নির্বাচনে মীর নাছিরকে পরাজিত করেছিলেন মহিউদ্দিন। নির্বাচনের এক দিন পর নাছিরকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। নোমানের কাছে সংসদ নির্বাচনে নিজের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে সেদিন মহিউদ্দিন তাঁকে বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে, রাজনীতিকদের ভেঙে পড়লে চলে না।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালে হরতালের সময় বিএনপির কর্মীরা সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়িতে হামলা করেছিল বলে নগর বিএনপির নেতা মীর নাছিরের বাড়ির সামনে আবর্জনার স্তূপ ফেলা হয়েছিল মহিউদ্দিনের নির্দেশে। এ ঘটনা তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এর কয়েক দিন পর একটি অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন উপযাচক হয়ে মীর নাছিরের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত নাছিরের স্ত্রীকে সস্নেহে মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছিলেন মহিউদ্দিন। এই ছবি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে অপ্রীতিকর ঘটনাটির কৌতুককর কিন্তু প্রীতিপ্রদ পরিণতি ঘটেছিল।

অতীতের এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাজনীতির মাঠে নানা বিরোধ থাকলেও সামাজিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তার উত্তাপ অনেকটাই হ্রাস করা যায়। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর জানাজায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভিন্নমতাবলম্বী সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও যে উপস্থিত ছিলেন, এটা সামাজিক সম্পর্কের স্বীকৃতি। এতে বোঝা যায় রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য সমর্থকদের যতই বিভক্ত করুক, সামাজিক সম্পর্কের দায় মানুষ এড়াতে পারে না।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিনই সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দুজন। আহত হয়েছেন বহু কর্মী-সমর্থক।

নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আশঙ্কা ও উত্তেজনা। এ রকম একটি সময়ে নেতা ও প্রার্থীদের আচরণের প্রভাব পড়বে কর্মী ও সমর্থকদের ওপর। তাঁরা যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতি সহিষ্ণু হন, শ্রদ্ধা-সমীহ-প্রীতির সামাজিক সম্পর্কটি ভুলে না যান, তাহলে নির্বাচন প্রতিহিংসার ক্ষেত্র না হয়ে প্রতিযোগিতামূলক হবে। এই সম্পর্ক বজায় রাখার দায় সরকারদলীয় প্রার্থীদের যে বেশি, তা তো বলাই বাহুল্য।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক