প্রথম আলোর ১২ জুলাই সংখ্যার মতামত পাতায় সাংসদ রুমিন ফারহানা ‘কেমন চলছে মিনিটে ২ লাখ টাকা ব্যয়ের সংসদ?’ শিরোনামের লেখায় একটি প্রশ্ন তুলেছেন এবং এর উত্তরও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি আপাতসমাধান প্রস্তাবও মাননীয় সাংসদ দিয়েছেন। গবেষণার প্রয়োজনে চার বছর ধরে আমাকে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করতে হচ্ছে। সে সূত্রে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার আলোচনা নিয়মিতই শুনি। বিভিন্ন অধিবেশনে দেওয়া তাঁর নিজ দলীয় নীতি ও অবস্থানকেন্দ্রিক বক্তব্যগুলো নিয়ে গবেষক হিসেবে কোনো মন্তব্য না করেও বলতে পারি, সাধারণভাবে প্রতিটি বক্তৃতার জন্য বিষয়ভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক যে প্রস্তুতি তিনি নেন, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সেটি আর দশজন সাংসদ থেকে তাঁকে আলাদা করার জন্য যথেষ্ট। সাংসদ রুমিন ফারহানার কলামের মূল বক্তব্য তিনটি।
প্রথমটি জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সাধারণ আলোচনা প্রসঙ্গে। এ অংশে সাংসদ বাজেট প্রণয়নে সরকারের ‘১ শতাংশ’ তোষণনীতিরও সমালোচনা করেছেন। সংসদ গবেষক হিসেবে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের ব্যাপারে মন্তব্য না করতে চাইলেও সরল একটি প্রশ্ন হয়তো আমি মাননীয় সংসদকে করতে চাইব। সেটি হচ্ছে, বর্তমান সরকারি দলের আলোচ্য অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলটি আদৌ মাননীয় সাংসদের নিজ দল বা জোটের অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের চেয়ে ভিন্ন কি না? বাজেট আলোচনায় ‘বাজেট’ না থাকার প্রশ্নে অবশ্য মাননীয় সাংসদের সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ নেই। গত তিন বছরের প্রতিটি বাজেট অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করে আমিও তা-ই দেখেছি। তবে মাননীয় সাংসদ যেটি উল্লেখ করেননি, সেটি হলো এ চিত্র শুধু গত তিন বছরের নয়। আমার পড়াশোনা বলছে, ক্ষমতাসীন দলনির্বিশেষে এটি কার্যত আমাদের পুরো সংসদীয় ইতিহাসেরই চিত্র।
আলোচনার দ্বিতীয় অংশে সংসদ সদস্যদের (বিশেষত সিনিয়র সদস্যদের) বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে মাননীয় সাংসদের হতাশা লক্ষণীয়। এ নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই যে আমাদের দেশে সে অর্থে পেশাদার পার্লামেন্টারিয়ান খুব বেশি নেই। আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতিবিদদের পড়াশোনায় অনীহার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে হলেও সমস্যাটির মূলে রয়েছে সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট, যেটির ইঙ্গিত মাননীয় সাংসদের কলামে নেই।
নিবন্ধের তৃতীয় ও শেষ অংশে সাংসদ রুমিন ফারহানা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অন্তত ট্রেজারি বিলের (অর্থ বিল বা বাজেট) ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দেওয়ার সুযোগের কথা বলেছেন। গবেষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এ প্রস্তাব সম্ভবত কিছুটা তাড়াহুড়া করে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা না করেই দেওয়া। মাননীয় সাংসদ যখন সরকারের ওপর অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সাংসদদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট না দিতে পারাটা মেনে নিতে পারছেন, তখন ধারণা করে নেওয়া যায় যে ৭০ অনুচ্ছেদের মূল যৌক্তিকতা (স্থিতিশীল সরকার) তিনি অনুধাবন করেন। সমস্যা হচ্ছে সংসদের বিরোধিতায় কোনো সরকার ট্রেজারি বিল বা বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলেও কিন্তু ‘স্থিতিশীল সরকার’ থাকার কথা নয়।
সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদের আইন বা অনুমোদন ছাড়া জনগণের ওপর এক পয়সার করারোপ করা রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সংবিধানের ৮৫ ও ৯০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদের আইন বা অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রীয় তহবিলের এক পয়সা উত্তোলন বা ব্যয় নির্বাহও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কোনো বছরে সরকার সংসদ অনুমোদিত বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করেও ফেলে, সেটিও পরের বছর সংবিধানের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। অবশ্য কোনো সরকার হয়তো সংবিধানের ৯২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে বাজেট পাস করানো ছাড়া এর বেশি সময় চালিয়ে নেওয়ার আর কোনো সরাসরি সুযোগ সংবিধানে নেই।
প্রসঙ্গক্রমে সাংসদ রুমিন ফারহানার নিজ দলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান সংবিধানে ৯২ক অনুচ্ছেদ যোগ করেছিলেন। এটিতে বলা ছিল, কোনো সংসদ বাজেট পাস না করলে সেই সংসদ রাষ্ট্রপতি ভেঙে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বাজেট পাস না হলে সরকার পতনের বদলে সংসদের পতন ঘটত। আশার কথা হচ্ছে, ৯২ক অনুচ্ছেদ এখন সংবিধানে নেই। তারপরও মাননীয় সাংসদের পরামর্শ মোতাবেক ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধিত হলে সংসদকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমেই সরকার বাজেট দিয়ে দিতে পারবে।
ধরা যাক, ৭০ অনুচ্ছেদের বাধা না থাকায় কোনো সংসদে সরকারে বাজেট পাস হলো না। সরকার প্রথমে ৯২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশ দিয়ে ৬০ দিন চালিয়ে নিলেন। তারপর সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদের আক্ষরিক বিধান মেনে আরও একটানা ৬০ দিন পর্যন্ত সংসদকে অধিবেশনের বাইরে রাখলেন। ইতিমধ্যে, সংবিধানের ৯৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই একটি বাজেট দিয়ে দিলেন। ৯৩ (৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে এ বাজেট সংসদ পরেরবার অধিবেশনে আসার ৩০ দিনের ভেতর পাস করিয়ে নিতে হবে। এভাবে মোট ১৫০ দিন (৫ মাস) পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিয়ে সরকার যদি দেখে সংসদ এখনো বাজেট পাস করবে না, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। আখেরে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিলুপ্ত হওয়া ৯২ক অনুচ্ছেদই কার্যকর হলো। অতিরিক্ত হিসেবে সরকারেরও পতন হলো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য অনাস্থা প্রস্তাব ও ট্রেজারি বিল (বাজেট)—দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটির ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর রেখে আরেকটিতে ছাড় দিলে কথিত ‘স্থিতিশীল সরকারের’ লক্ষ্য পূরণ হয় না।
মাননীয় সাংসদ অবশ্য দাবি করছেন, বাজেটের বেলায় ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিলেই সাংসদরা তাৎক্ষণিক দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া শুরু করবেন না। এর ফলে সরকার ‘পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভীত থাকবে’। আমার মনে হয় সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে পুরো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোয় ভারসাম্যহীনতা তৈরি না করেও এ ‘ভীতি’টুকু সঞ্চার করা যায়।
আমাদের সংসদের কার্যপ্রণালিবিধিতে বাজেট সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর বিধান নেই। ধারণা করা যায়, বাজেট সময়মতো পাস করানোর তাগিদ থেকেই হয়তো এমন বিধান। অথচ ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যবস্থার সূতিকাগার ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও সংসদীয় কমিটির কাছে বাজেট পাঠাতে হয়। সেখানে বাজেট প্রণয়ন ও পাসের প্রক্রিয়াটি দুই ধাপে প্রায় ছয় মাস সময় নিয়ে করা হয়। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ওপর সংসদীয় কমিটি পর্যায়ে এমন অর্ধ বর্ষব্যাপী পর্যালোচনার সুযোগ নিঃসন্দেহে সরকারকে কিছুটা ‘ভীত’ করতে পারে। বাজেট প্রক্রিয়াকে দ্বিস্তরে বিন্যস্ত করে এবং বাজেট প্রস্তাব বিশেষায়িত সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়ে আমরাও হয়তো সরকার ও আমলাতন্ত্রে কিছুটা ‘ভীতি’ সঞ্চার করতে পারি। তা ছাড়া একটি কার্যকর সংসদীয় কমিটির ব্যবস্থা মাননীয় সাংসদের উত্থাপিত আরেকটি সমস্যারও (বিশেষজ্ঞ জ্ঞান) কিছুটা সমাধান দিতে পারে।
সারা দুনিয়ার প্রায় সব সংসদের ক্ষেত্রেই মূল অধিবেশন কক্ষটি রাজনৈতিক বক্তব্যের লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবেই দেখা হয়। বলা হয় সংসদের চোখ-কান এবং হাত-পা হচ্ছে সংসদীয় কমিটিগুলো। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক কিথ ক্রেবিয়েল সংসদীয় কমিটিকে সংসদের জন্য নির্মোহ (রাজনৈতিক নয়) তথ্য এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক অ্যান্থনি কিং ১৯৭৬ সালে জার্মান, ফরাসি ও ব্রিটিশ সংসদের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার ওপর একটি তুলনামূলক গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, সংসদীয় কাঠামোতে শুধু দলের মধ্য থেকে বিরোধিতাই সংসদের একমাত্র চেহারা নয়। সংসদের কাঠামো এবং এর প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থা এমনভাবে সজ্জিত হতে হবে, যেখানে নির্দলীয়, আন্তদলীয় এবং অন্তর্দলীয় প্রক্রিয়ার সব কটি ধারা বিকশিত হয়। সংসদের মূল অধিবেশন কক্ষটি অনেকটাই দ্বান্দ্বিক চরিত্রের হলেও অ্যান্থনি কিং কমিটি ব্যবস্থাকে নির্দলীয়, আন্তদলীয়, এবং অন্তর্দলীয় মিথস্ক্রিয়ার স্থান হিসেবে দেখেছেন।
দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে গণতন্ত্রবিহীন এবং ব্যক্তিগত আনুগত্যভিত্তিক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার কারণে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলোয় ৭০ অনুচ্ছেদ না থেকেও আছে। আমাদের সাংসদদের বেলায় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত। সরকারের নীতি বা আমলাতন্ত্রের জবাবদিহির প্রশ্নে সংসদীয় কমিটির গণশুনানি বা গণতদন্ত করার চর্চা খুব একটা নেই। যেসব সরকারি আইন প্রস্তাব সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া, মতগুলোকে রাজনীতি নির্মোহভাবে বিবেচনা করা এবং প্রয়োজনে গ্রহণ করার মানসিকতার অনুপস্থিতিতে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো অধ্যাপক কিথ ক্রেবিয়েলর ভাষায় তথ্য ও বিশেষায়িত জ্ঞান সরবরাহকারী হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
সুতরাং সংসদের সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার হবে সাংসদের নিজের দলসহ সব রাজনৈতিক দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চা এবং সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থাকে কাজ করতে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা ও ঐকমত্য। তারপরও অন্তত একজন সাংসদের তরফে সংসদ নিয়ে চিন্তা-উপলব্ধি আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। এটি তাঁর নিজ দলের নীতিনির্ধারক, সদস্যপর্যায়সহ সব রাজনৈতিক দলে ভেতরে সঞ্চারিত হলে সেটি জাতির জন্য সুখকর হবে।
এম জসিম আলী চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের সংসদ বিষয়ক পিএইচডি গবেষক।