সলোমন দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হনিয়ারায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে গেল সপ্তাহে বড়সড় বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অভিযোগ তোলে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে সেটা সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা আইনসভার বাইরে একটা ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়, একটা পুলিশ স্টেশনে হামলা চালায়। হনিয়ারায় একটি চীনা শহরের বেশির ভাগটা আগুনে পুড়িয়ে দেয় ও লুটপাট চালায়।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব কত, সেটা আমেরিকানদের ভালো করে জানা উচিত। ‘গুয়াডানক্যানেল’ শব্দটাই সেটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে আমেরিকার নৌ-সেনা এবং জাপানি বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র দশকের পর দশক এ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে মোটেই মনোযোগ দেয়নি। যদিও এর গুরুত্ব এখন ১৯৪২ সালের চেয়েও অনেক বেশি। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় সলোমন দ্বীপপুঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘কৌশলগত অঞ্চল’। সলোমনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া মানে অস্ট্রেলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি এশিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দক্ষিণ–পশ্চিম এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বেইজিং তার দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবে সেটাই করতে চাইছে।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দিকে চীনের শ্যেন দৃষ্টি দীর্ঘদিনের। ২০১৯ সালে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভার তাইওয়ান থেকে বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক ভারকেন্দ্র বদল করে। গুঞ্জন আছে যে সোগেভার ও অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা বড় অঙ্কের টাকা নেন এ জন্য। চীন সলোমন দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ঘাঁটি করতে যাচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। কূটনৈতিক ভারকেন্দ্র বদলের এ ঘটনা সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বিদ্যমান অসন্তোষ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দিকে চীনের শ্যেন দৃষ্টি দীর্ঘদিনের। ২০১৯ সালে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভার তাইওয়ান থেকে বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক ভারকেন্দ্র বদল করে। গুঞ্জন আছে যে সোগেভার ও অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা বড় অঙ্কের টাকা নেন এ জন্য। চীন সলোমন দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ঘাঁটি করতে যাচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। কূটনৈতিক ভারকেন্দ্র বদলের এ ঘটনা সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বিদ্যমান অসন্তোষ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে মালাইটার প্রদেশের প্রধান নেতা ড্যানিয়েল সুইদানি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের বিরোধিতা করে আসছেন। মালাইটার বেশির ভাগ বাসিন্দা সুইদানিকে সমর্থন করেন, তাঁরা স্বাধীনতার দাবিও তুলছেন। অন্যদিকে সোগেভার মালাইটার বিশাল সম্পদ চীনা মালিকানাধীন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সেই পরিকল্পনায় বাধা আসায় তিনি মোটেই খুশি নন।
এ বছরের শুরুর দিকে সুইদানি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাইরে গিয়ে তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সোগেভার সরকার তাকে সেই অনুমতি দেয়নি। তাঁরা আশা করেছিলেন সুইদানির মৃত্যু হলে মালাইটা সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাইওয়ানে গিয়ে তিনি চিকিৎসা নেন। চিকিৎসা শেষে ফিরে আসার পর সোগেভারের ঘনিষ্ঠরা সুইদানির বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনসভায় রহস্যজনকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। গণ প্রতিরোধে সেই প্রচেষ্টা থেকে তঁারা সরে আসেন এবং ক্ষমা চান। এ ঘটনার পেছনে বেইজিংয়ের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা চীনাদের বাঁকা চোখে দেখেন। কেননা তাঁরা স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করছেন। চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে চীন থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হচ্ছে। মুনাফা ও কাঁচামাল তারা পাচার করছে। ফলে স্থানীয়রা চীনা বিনিয়োগে নিজেদের খুব সামান্যই লাভবান হতে দেখছেন। পাশাপাশি সংঘবদ্ধ অপরাধ ও দুর্নীতির বিস্তার হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে গেল সপ্তাহের বিক্ষোভ ও দাঙ্গা–হাঙ্গামা অনিবার্য ছিল।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তামাশার যেন শেষ নেই! অস্ট্রেলিয়া সোগেভার সরকারকে সহযোগিতা করতে সেনা, পুলিশ ও কূটনীতিকদের পাঠিয়েছে। চীনের সঙ্গে বাজে ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের পরও চীনের অনুগত সলোমন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করতে সেনা পাঠিয়েছে। যে নাগরিকেরা চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিক্ষোভ করল, তাদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিল অস্ট্রেলিয়া। বেইজিংয়ের এখন উচিত মরিসন সরকারকে ধন্যবাদ জানানো।
যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ নাগরিকের কাছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। তাঁরা ভাবছেন মার্কিন দূতাবাসই সেখানকার সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট। যদিও সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসই নেই। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ওপর নির্ভর করে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অস্ট্রেলিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এখন যে যা–ই বলুক না কেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নাই মানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও সেখানে রক্ষিত হবে না।’ সলোমন দ্বীপপুঞ্জের রাজনীতি ও স্থানীয় বিষয়ে প্রভাব তৈরির মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সেই সোনালি সুযোগ যুক্তরাষ্ট্র হাতছাড়া করেছে। দ্বীপপুঞ্জের অনেক আইনপ্রণেতা চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি যেন সেখানে থাকে। তারা সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস যাতে স্থাপন করা হয়, সে জন্য অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ না দেখে তাঁরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অন্য যেকোনো প্রেসিডেন্টের তুলনায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি ও স্বার্থ নিশ্চিত করতে সে পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। ২০২০ সালে ইউএসএআইডির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মালাইটাতে সরাসরি ২৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল দেয়। কিন্তু চীনের প্রভাব ঠেকাতে সেখানে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন করতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত
গ্রান্ট নিউজহ্যাম সাবেক মার্কিন কূটনীতিক এবং টোকিওতে অবস্থিত জাপান ফোরাম ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো