সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের কী হলো
বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো–সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারত্বমূলক উদ্যোগের (পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি) ওপর সরকার গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে পিপিপি পলিসি প্রণয়ন করা হয়েছে, পিপিপি আইন গৃহীত হয়েছে ২০১৫ সালে। পিপিপি আইনে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করে পিপিপি অফিস খোলা হয়েছে। পিপিপি অফিসের ওয়েবসাইটে ৭৪টি প্রকল্পের একটি দীর্ঘ তালিকা আছে, সেগুলোর মধ্যে একটি অতি ক্ষুদ্র কিডনি ডায়ালাইসিস (দুটি ইউনিট) প্রকল্প চালু আছে। নির্মাণাধীন প্রকল্পের সংখ্যা ৫, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ৭টি, ৩টি চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে, সংগ্রহাধীন ১৪টি, প্রস্তুতি পর্যায়ে আছে ২৯টি প্রকল্প এবং নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে ১৪টি প্রকল্প। তালিকা দীর্ঘ হলেও কিন্তু অর্জন খুবই সামান্য। এত ঢাকঢোল পেটানোর পরও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক বলা চলে।
কেন এমন হলো?
বাংলাদেশে পিপিপি নীতি ও আইন হওয়ার আগে থেকেই পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিতে বড় প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে মেঘনাঘাট ৪৫০ ও হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প এর উদাহরণ। তারও আগে স্থাপিত কর্ণফুলী সার কারখানাকেও অনেকে পিপিপি প্রকল্প বলে থাকেন, যদিও এটাকে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রকল্প বলা সমীচীন হবে। মেঘনা ঘাট ৪৫০ ও হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প আদর্শ পিপিপি অর্থায়ন প্রকল্প হিসেবে ‘ইউরোমানি’পদক লাভ করে।
এই প্রকল্পগুলোর বিদ্যুতের দাম এত কম ছিল যে এগুলোকে ভিত্তি ধরে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। শুধু বিদ্যুতের সাশ্রয়ী মূল্য নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের প্রধান বেসলোড প্ল্যান্ট হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। সারা বিশ্বের নামকরা মার্কিন, জাপানি, কোরিয়ান বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো যেমন এইএস, মারুবেনি, হুন্দাই এ উদ্যোক্তা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল। আজকাল কেবল চীন ও ভারতের নিম্নমানের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে টেন্ডার–প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। তখন আশা করা হয়েছিল যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থায়ও পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের বাইরে সড়ক, পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিমানবন্দর প্রভৃতি পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে। স্পষ্টতই সে প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে এশীয় আর্থিক সংকটের পর থেকেই এ অঞ্চলে পিপিপি প্রকল্পের খরা চলছে। যা কিছু পিপিপি প্রকল্প হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে চীন, ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক ও মেক্সিকো—এ পাঁচ বড় দেশে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক কম। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত ছাড়াও এর দেশজ কারণ আছে।
প্রথমত, পিপিপি পলিসি, আইন, অফিস স্থাপন করা হলেও সরকারের বিশাল অংশ এটাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি। এর কারণ হলো ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অর্থায়নের অন্যতম উত্স। তাঁরা এ ধরনের প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ হারাতে চান না।
দ্বিতীয়ত, পিপিপি মডেলকে বিকৃত করে আপত্কালীন ব্যবস্থা রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের আবরণে প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোক্তা নির্বাচনের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও বেশি ব্যয়ের অদক্ষ অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা যোগ হয়েছে; এর দায় পরিশোধ করতে গিয়ে একক ক্রেতা বিপিডিবির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বিদ্যুৎ খাতের এ ধরনের বিপণন ঝুঁকিমুক্ত বিজনেস মডেল ও অতিরিক্ত প্রণোদনার কারণে উদ্যোক্তারা আর সড়ক, খাওয়ার পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিমানবন্দর—এ ধরনের প্রকল্প পিপিপি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী হচ্ছে না।
কী করতে হবে?
এ ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের কী করতে হবে? প্রথমেই পিপিপির পক্ষে ন্যায্য ও অসার যুক্তি কোনগুলো বুঝতে হবে। প্রধানত পিপিপির পক্ষে বেসরকারি পুঁজি ও অর্থায়নকে প্রধান যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এটা একটা অসার যুক্তি। কেননা, সরকার আরও কম দামে এ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে টাকা কম লাগলেও ভবিষ্যতে এর জন্য ব্যয় বাড়ে বা ভবিষ্যৎ আয় কমে। পিপিপির পক্ষে ন্যায্য যুক্তি হচ্ছে উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যক্তি খাতের ডায়নামিক দক্ষতা বৃদ্ধি, যা কেবল প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোক্তা নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এ জন্য প্রয়োজন হবে ব্যক্তি খাতে ঝুঁকি গ্রহণে সক্ষম ও আগ্রহী উদ্যোক্তা নির্বাচন। এটা করতে হলে—
প্রথমত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিল করতে হবে। প্রণীত হওয়ার পর চারবার মেয়াদ বাড়িয়ে বর্তমানে ২০২১ সাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বহাল রাখা হয়েছে। একসময় সাময়িক প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ খাতে আমাদের দেশের মতো ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার বা আইপিপি এখন আর বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে মার্চেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার পদ্ধতি বা এমপিপি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে উদ্যোক্তা বিপণনঝুঁকি গ্রহণ করে, বড় বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ব্যবহারের সরকার–নির্ধারিত হারের জন্য হুইলিং চার্জ প্রদান করে। মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে বিপিডিবির আর্থিক কোনো দায় থাকবে না। ফলে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি নীতিমালা ২০০৮ সালেই তৈরি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে এটা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে দলীয় তহবিল সংগ্রহ বন্ধ করার জন্য, রাজস্ব আয় থেকে রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন করে বর্তমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় বিদ্যমান দুর্নীতিতে লাগাম টেনে ধরতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই তা করা হয়ে থাকে। এটা করা হলে রাজনৈতিক দল ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিও হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
চতুর্থত, বর্তমানে কেবল শহুরে বড় ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পকে পিপিপির আওতায় ভাবা হয়। কিন্তু বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সৌরবিদ্যুৎ–ভিত্তিক সেচ প্রকল্প, মিনি গ্রিড—এসবও পিপিপির আওতায় আনতে হবে। এসব প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনক করার জন্য প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান করতে হবে, যাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। উল্লেখ্য, সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ইডকল পিপিপি ভিত্তিতে সৌরশক্তির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৪০ লাখের বেশি গ্রাহককে বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে।
পঞ্চমত, সড়ক ও অন্যান্য খাতে পিপিপি সফল করার জন্য সরকারকে এসব প্রকল্পের অন্তত আংশিক ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টোল সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার একটি ন্যূনতম পরিমাণের চেয়ে যানবাহন চলাচল কম হলে সরকার প্রকল্পের উদ্যোক্তাকে ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
ষষ্ঠত, পিপিপি অফিসকে গতিশীল ও এর সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য অন্যান্য দেশের মতো পিপিপি অফিসকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করে এখানে আর্থিক, চুক্তি আইন ও কারিগরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিতে হবে।
সপ্তমত, বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন পাওয়ার সেলের মতো সড়ক, রেলপথ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পেশাদারদের নিয়ে বিশেষ সেল গঠন করতে হবে, যারা পিপিপি প্রকল্প প্রক্রিয়াজাত করবে। এ ধরনের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার অভাবে একজন বেসরকারি উদ্যোক্তা ঢাকা-জামালপুর-ঢাকা লাইনে দ্রুতগতির ট্রেন চালু করার প্রস্তাব দিয়েও সাড়া পাননি।
সবশেষে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন, ও পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে হবে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বাংলাদেশ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব