স্কুলজীবনে দুই লাইন কবিতা পড়েছিলাম: ‘অসুন্দরে নাশবি যদি, গড়বি নব নন্দনে রে’। এটি কার কবিতা, শিরোনামই–বা কী, তা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু সবাই বোঝেন: নতুন ভালো বাগান (নন্দন) সৃষ্টি করতে হলে বর্তমানে যা কিছু অসুন্দর, জঞ্জাল রয়েছে, তা নাশ বা বিলুপ্ত করেই এগোতে হবে।
বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক চাকরির পরেই বেসরকারি করপোরেট সংস্থার চাকরি ছিল সবচেয়ে লোভনীয়। কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মতো ইদানীং সরকারি চাকরি আবার সে স্থানটি দখল করে নিয়েছে। অথচ এই সরকারি চাকরিতে শুধু বয়সের মারপ্যাঁচ কিছু অবিচার ও অসুন্দর হিসেবে শিকড় গেড়ে বসেছে।
সরকারি চাকরিতে ‘প্রবেশের বয়স’ বিষয়টি দেশের তরুণদের কাছে অবিচার হিসেবে ধরা দিচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর; স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু দিক থেকেই এই বয়স ২৭ বছরে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছরের সামরিক-আধা সামরিক শাসনের পর নতুনভাবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এলে সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে।
কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে দিনবদলের ধারায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রাফি ৩০ জুলাই ২০২০ তারিখে দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা’ শীর্ষক লেখায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন: ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয় থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন, কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিবছর বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, ২. উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচির সঙ্গে বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষা-কোর্সের বিস্তর পার্থক্য থাকায় তাঁদের আবার নতুন করে চাকরির পড়াশোনা করতে হয়, ৩. করোনার ফলে শিক্ষার্থীরা এখন ঘরবন্দী, সাত-আট মাস ধরে কোনো চাকরির আবেদনও করতে পারছেন না, ৪. পরিণামে বেকারদের মনোবল ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে।
এসব বিবেচনায় তরুণ শিক্ষার্থী রাফির যৌক্তিক জোর দাবি: তাঁদের মনোবল চাঙা করতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হোক।
একই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ‘দক্ষতা ও যোগ্যতার অপচয় কাম্য নয়’ শীর্ষক নিবন্ধে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে নতুন কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন: ১. চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় পদ অনেক কম থাকায় চাকরিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়ার জন্য গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও চার-পাঁচ বছর সময় দরকার, ২. চাকরিতে প্রবেশের সরকারি বয়সসীমা অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও অনুসরণ করে বলে প্রার্থীরা সেসব চাকরির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন।
চাকরির সীমিত সুযোগ এবং করোনার কারণে এবার বিসিএস পরীক্ষাও স্থগিত থাকায় প্রার্থীরা ৫-৬ মাস নয়, পুরো একটি বছর পিছিয়ে পড়েছে; আসন্ন শীতে করোনার নতুন ঢেউ এলে সেটি দুই বছরে পৌঁছানোর সমূহ সম্ভাবনা তৈরি করবে। আর বিপুল আয়োজনে দেশমাতৃকার তরুণদের লেখাপড়া শিখিয়ে বয়সের মারপ্যাঁচে ফেলে বেকারত্বের গ্লানি উপহার দেওয়া তো কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না!
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বর্তমান বয়সটি অসুন্দর। এ অঞ্চলে একসময় চাকরি থেকে অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রায় শুরু থেকেই অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। এ অবস্থা প্রায় ২০ বছর ধরে চলে। ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স একবারে তিন বছর বৃদ্ধির সাপেক্ষে অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়ানোর যুক্তি মজবুত থাকলেও সরকার ২০০৯ সালে তা মাত্র দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছরে উন্নীত করে।
অবসরের বয়স বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে অধ্যাপক শাহনাওয়াজ উল্লিখিত নিবন্ধে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে আছে: ১. স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫২ বছর, যা বিগত ৪০-৪৫ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর, ২. অকালে অবসরে যাওয়া এই মানুষগুলো সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন, কিন্তু কর্ম পাচ্ছেন না (ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে), ৩. সুস্থ-সবল দক্ষ ও অভিজ্ঞ এই মানুষগুলোর সেবা না নেওয়া জাতীয় অপচয়, ৪. কয়েকটি দেশে অবসরের বয়স (ভারতে ৬০ বছর, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে ৬৫ বছর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানে ৬৬ বছর) বাংলাদেশের এ বয়স থেকে ঢের বেশি।
তরুণদের দাবি ও আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বয়স্কদের অভিজ্ঞতা আরও কিছুদিন কাজে লাগানোর চিন্তা সরকারের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল। তার নির্যাস সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অচিরেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বেড়ে ৩২ বা ৩৫ এবং অবসরের বয়স বেড়ে ৬০ বা ৬২ বছর হচ্ছে।
সদাশয় সরকার সব দিক বিবেচনায় নিয়ে অতি সত্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স অন্তত ৩২ বছর এবং পরীক্ষার জন্য তিন বছর বরাদ্দ ধরে ২৫ বছর কর্মকাল রাখার হিসেবে অবসরের বয়স অন্তত পূর্ণ ৬০ বছরের ঘোষণা দিয়ে, সম্ভব বলে গত জুলাই থেকে তা কার্যকর করবেন।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য।
[email protected]