২০১০ সালে যখন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’ নামে একটি আইন জারি করা হয়, তখনই আমরা আতঙ্কিত হয়েছিলাম। কেননা, এর বিভিন্ন ধারা–উপধারা দেখে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছিল, সরকার এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, যেগুলো জনস্বার্থবিরোধী, তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের এবং আইন–আদালতে এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দণ্ডিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণে আগেই তাদের দায়মুক্তি দিয়ে এ আইনের বেড়া দেওয়া। আমরা যা ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ। সরকার বিদ্যুৎ–ঘাটতি দূর করার অজুহাত দিয়ে সুন্দরবন বিনাশসহ উপকূলকে তছনছ করার মতো একের পর এক কয়লাবিদ্যুতের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আইন অনুযায়ী সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো স্থাপনা না করার বিধান থাকলেও সেখানে সরকার পরিবেশ দূষণকারী দুই শতাধিক শিল্পকারখানার অনুমোদন দিয়েছে। সরকারের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব এলাকার বনজ জমি দখল করে সেখানে পরিবেশ বিপর্যয়কারী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পথে বাধা সৃষ্টি করে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথ জটিল করে নেওয়া হয়েছে এলএনজি আমদানি এবং বিষাক্ত কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের পথ। এসব পথে দেশের মানুষের জন্য ব্যয় বেশি, ঝুঁকি বেশি আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুনাফা আর কমিশনের সুযোগও বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের আক্রমণের মুখে যখন সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার উপকূল আরও প্রাকৃতিক বর্মে সজ্জিত করা দরকার, তখন এর উল্টো পথই বেছে নিয়েছে সরকার। কোনো জবাবদিহি নেই, প্রকল্প ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা নেই, ন্যূনতম পরিবেশ সমীক্ষার শর্তও অনিয়মে ভরা। এ আইনবলেই সরকার দেশি–বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর পকেট ভরার জন্য ইচ্ছেমতো চুক্তি করছে, প্রকল্প ব্যয় আকাশচুম্বী হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎপ্রাপ্তির খরচ বাড়ছে, তাই দাম বাড়ছে নিয়মিতভাবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়ে এবং বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে সেগুলোকে বিপুল অপচয় ও দুর্নীতির আখড়া বানানো হয়েছে। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের পথ দুর্গম করে বিভিন্ন ব্যয়বহুল চুক্তি করা হয়েছে। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পথে বাধা সৃষ্টি করে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথ জটিল করে নেওয়া হয়েছে এলএনজি আমদানি এবং বিষাক্ত কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের পথ। এসব পথে দেশের মানুষের জন্য ব্যয় বেশি, ঝুঁকি বেশি আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুনাফা আর কমিশনের সুযোগও বেশি।
বিদ্যুৎ–ঘাটতির অজুহাতে এ খাতে দ্রুত পরিবর্তন আনার নাম করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ জনস্বার্থবিরোধী নানা চুক্তি অথবা অন্য কোনো কার্যক্রম বা গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, কিংবা আদেশ-নির্দেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে কোনো ধরনের প্রতিকার পাওয়ার নাগরিক অধিকার হরণ করে ২০১০ সালে প্রণীত এ দায়মুক্তি আইন প্রথমে দুই বছরের জন্য করা হয়। পরে ২০১২ সালে এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। ২০১৪ সালে এসে এর মেয়াদ আরও চার বছরের জন্য বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর এ আইনের মেয়াদ আবারও বাড়ানো হলো পাঁচ বছরের জন্য।
২০১০ সালে প্রণীত এ আইনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমেই অনেকগুলো ‘যেহেতু’ বর্ণনা করা হয়েছিল, যেমন—
‘যেহেতু দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি চরমভাবে বিরাজ করিতেছে; এবং
‘যেহেতু জ্বালানি সরবরাহের স্বল্পতা হেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না; এবং
‘যেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতির কারণে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজকর্ম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং উক্ত খাতসমূহে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হইতেছে না; এবং
‘যেহেতু বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নতুন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, প্রযুক্তির বিকাশ, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হইতেছে এবং জনজীবনে অস্বস্তি বিরাজ করিতেছে...’ ইত্যাদি।
সরকার নিজেই যখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক সাফল্যের দাবি করছে, যখন বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকার কারণে কিছু কোম্পানিকে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করার জন্য, তখন এসব ‘যেহেতু’ অকার্যকর হয়ে যায়। সরকার তারপরও সেই দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ আবারও বৃদ্ধি করেছে, বাড়ানো হয়েছে বসিয়ে খাওয়ানো কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদও। তার মানে, আমাদের আশঙ্কা, বিদ্যুতের জন্য নয়, কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে ভয়াবহ এসব চুক্তি বা প্রকল্প আমাদের ঘাড় থেকে নামবে না। বরং আরও নতুন নতুন বিষাক্ত প্রকল্প ঘাড়ে চাপতে যাচ্ছে।
উপরিউক্ত আইন অনুযায়ী, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়কে অসীম ক্ষমতা দেওয়া আছে এবং সেই সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের রক্ষাবর্ম তৈরি করা হয়েছে। ৯ ও ১০ ধারায় আছে: ‘৯। এ আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। ১০। এ আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
শুধু তা–ই নয়, ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে, যেন এ আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই।’ তার মানে, এই আইনের রক্ষাকবচ বহুদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1059.html
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নাকি কোনো দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই, তাহলে এ দায়মুক্তি কেন? এসব আইন অনুযায়ী, সব ক্ষমতাবান ব্যক্তিরই ‘সরল বিশ্বাসে’ যেকোনো ক্ষতি বা অপরাধ করার অধিকার আছে, তাতে দেশের মানুষের যত বড় সর্বনাশই হোক না কেন। আইনের ধরনই বলে দেয় মহাবিপর্যয় ঘটলে তাদের ভূমিকাকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ বলেই ধরে নেওয়া হবে।
ছয় বছর আগের একই দিনে (১৬ সেপ্টেম্বর) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, ২০১৫–তে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যও দায়মুক্তির বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছিল। এ আইনের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘(১) কোম্পানি কর্তৃক বা ইহার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক বা অন্য কোন পরিচালক কর্তৃক সরল বিশ্বাসে তাহার কর্তব্য পালনকালে কৃত সব ক্ষতি এবং ব্যয়ের জন্য চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক ও অন্যান্য পরিচালকগণ কোম্পানি, বা ক্ষেত্রমতো সরকার কর্তৃক দায়মুক্তি পাইবে, যদি না উক্ত ক্ষতি ব্যয় তাহাদের ইচ্ছাকৃত কার্য বা অবহেলার কারণে সংঘটিত হইয়া থাকে।’ ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পূর্বে বা সময় বা পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার বিষয়ে সরল বিশ্বাসে কৃত কোন কাজকর্মের জন্য সরকার, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, অন্য কোন পরিচালক, পরামর্শক, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’ http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1165.html
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নাকি কোনো দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই, তাহলে এ দায়মুক্তি কেন? এসব আইন অনুযায়ী, সব ক্ষমতাবান ব্যক্তিরই ‘সরল বিশ্বাসে’ যেকোনো ক্ষতি বা অপরাধ করার অধিকার আছে, তাতে দেশের মানুষের যত বড় সর্বনাশই হোক না কেন। আইনের ধরনই বলে দেয় মহাবিপর্যয় ঘটলে তাদের ভূমিকাকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ বলেই ধরে নেওয়া হবে। আর্থিক বোঝা আর প্রাণ–প্রকৃতি বিনাশের ভয়াবহ বিপদ থাকবে দেশের মানুষের জন্য।
কেন সরকারের দায়মুক্তির ঢাল দরকার? যে কেউ বুঝতে পারেন, যা খুশি তা–ই করার জন্য, দুর্নীতি-অনিয়ম অপ্রতিরোধ্য রাখার জন্য—এ আইন সুরক্ষাব্যবস্থা! সব ক্ষেত্রে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, ভিন্নমতের, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন ভূমিকা গ্রহণের পথ বন্ধ করেও সরকারের স্বস্তি নেই। এসব দায়মুক্তি আইন দিয়ে অপরাধীদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আইনি সুরক্ষা দিতে সরকার অস্থির।
শুধু বিদ্যুৎ–জ্বালানির ক্ষেত্রেই নয়, ক্রসফায়ারে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ভাষায় দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কৃতকর্মের দায় থেকে সরকার অপরাধীদের মুক্ত রাখার আয়োজন করলেও সমাজে, ইতিহাসে নানাবিধ অপূরণীয় ক্ষতি আর সর্বনাশের দায় থেকে তাদের কেউ মুক্ত করতে পারবে না।
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক