সমাজে ‘বেকুবের’ সংখ্যা বাড়ুক

শাজাহান খান ও ইলিয়াস কাঞ্চন
ছবি: প্রথম আলো


বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাংসদ শাজাহান খান নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে ‘কত বড় বেকুব’ বলে সম্বোধন করেছেন। গত শুক্রবার রাজশাহীতে বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস কাঞ্চন একজন বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ। উনি বলেন, এই আইনের যদি সংশোধন হয়, তাহলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। কত বড় বেকুব হলে এ কথা বলতে পারেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।’

শাজাহান খান কেবল পরিবহন শ্রমিকনেতা নন, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। শাজাহান খান এখন যে পরিবহন আইনের বিরোধিতা করছেন, সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, সেই আইন সংসদে পাস হয়েছে তিনি মন্ত্রী থাকাকালেই। সংসদে আইনটি পাস হওয়ার আগে যে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়া অনুমোদন হয়, সেই মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন তিনি। আইনের কোনো ধারা তাঁর কাছে অসংগতিপূর্ণ মনে হলে সে সময় তিনি আপত্তি করলেন না কেন?

শাজাহান খান শুধু ইলিয়াস কাঞ্চনেরই সমালোচনা করেননি, সমালোচনা করেছেন যেসব বুদ্ধিজীবী নিরাপদ সড়ক চান, তাঁদেরও। তিনি বলেছেন, বুদ্ধিজীবীরা পরিবহনশ্রমিকদের দেখতে পারেন না। তাঁর এই কথা সম্পূর্ণ অসত্য। যাঁরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁরা পরিবহনশ্রমিকদের বিরোধিতা করছেন না। তাঁরা বিরোধিতা করছেন সেসব শ্রমিকনেতার, যাঁরা যাত্রীদের পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছেন, যাঁরা প্রায় অভুক্ত পরিবহনশ্রমিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিচ্ছেন তাঁদের কল্যাণের কথা বলে।

বাংলাদেশে পরিবহনমালিকেরা শ্রম আইন মানেন না, শ্রমিকদের প্রাপ্য ছুটি দেন না। নিয়োগপত্র দেন না। কথায় কথায় চাকরি খান। মাত্র কদিন আগে ভৈরবে বাসে আগুন লেগে ঘুমন্ত অবস্থায় এক চালক মারা যান। চালককে কেন বিশ্রামের সময় বাসেই ঘুমাতে হবে? বাসমালিক কেন ঘুমানোর জন্য নিরাপদ জায়গা দেবেন না?

মন্ত্রী হিসেবে তিনি আইন পাস করেছেন, আবার শ্রমিকনেতা হিসেবে আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করেছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে একই ব্যক্তির এ রকম দ্বিমুখী ভূমিকায় থাকার নজির আছে কিনা জানা নেই।

পরিবহনশ্রমিক সংগঠনের এই কথিত নেতারা এই বাসচালকের মৃত্যু নিয়ে কথা বলেন না। তাঁরা কথা বলেন সরকার প্রণীত পরিবহন আইন নিয়ে। শাজাহান খান বলেছেন, ২০১৮ সালে বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে আইন পাস করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি নিজের সরকারকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি আইন পাস করেছেন, আবার শ্রমিকনেতা হিসেবে আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করেছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে একই ব্যক্তির এ রকম দ্বিমুখী ভূমিকায় থাকার নজির আছে কিনা জানা নেই।

পরিবহন খাতের একটি চক্র নিজেদের দখলদারি বহাল রাখতে শ্রমিকদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছেন কখনো সরকারের বিরুদ্ধে, কখনো ইলিয়াস কাঞ্চন ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে। তাঁরা সব সময় শ্রমিকদের জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন কিন্তু কীভাবে সড়ক নিরাপদ হতে পারে, কীভাবে দুর্ঘটনা কমতে পারে, সে বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। শাজাহান খানের মতে দেশে এখনো একটি যুগোপযোগী পরিবহন আইন হয়নি। এরশাদের শাসনামল থেকে তাঁরা যুগোপযোগী আইনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। এরশাদের শাসন শেষ হয়েছে তিন দশক আগে। আওয়ামী লীগও একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় আছে। তারপরও যদি যুগোপযোগী আইন না হয়ে থাকে, সে জন্যও কি ইলিয়াস কাঞ্চন দায়ী?

এই পরিবহন শ্রমিকনেতা কাম সাংসদ বিরামহীন আক্রমণের তির ছুড়ে চলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে জেলা মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের চালক প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি ইলিয়াস কাঞ্চনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি যে বিদেশিদের কাছ থেকে নিরাপদ সড়ক চাই এনজিওর নামে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন, আপনি কয়টা প্রতিষ্ঠান করেছেন? কয়টা স্কুল করেছেন? কতজন মানুষকে টেনে নিয়েছেন? ইলিয়াস কাঞ্চন কোথা থেকে কত টাকা পান, কী উদ্দেশ্যে পান এবং সেখান থেকে নিজের নামে নেতৃত্ব, বধূর নামে লাখ লাখ টাকা নেন, সেই হিসাব আমি জনসমক্ষে তুলে ধরব।’

শাজাহান খান এই বক্তব্য দিয়েছেন এক বছরেরও বেশি সময় আগে। এত দিনেও তিনি ইলিয়াস কাঞ্চন ‘কোথা থেকে কত টাকা পান’, সেই হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি। এই বক্তব্যের পর ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। মামলার আরজিতে বলা হয়, তাঁকে ( ইলিয়াস কাঞ্চন) নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিবাদী শাজাহান খান তাঁর সম্পর্কে মনগড়া ও মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন।

অতি বুদ্ধিমানদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশ এখন প্রায় বিপর্যস্ত। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো দু-একজন ‘বেকুবের’ ভীষণ প্রয়োজন, যাঁরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন। প্রবলের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

ইলিয়াস কাঞ্চন কোথা থেকে কত টাকা পেয়েছেন, শাজাহান খান সেই হিসাব দিতে না পারলেও সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। ২২ অক্টোবর সড়ক নিরাপত্তা দিবসে বিআরটিএ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে ইলিয়াস কাঞ্চনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর প্রতিবাদে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের কোনো প্রতিনিধি সেখানে যাননি। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইলিয়াস কাঞ্চন যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তা ব্যক্তি স্বার্থে নয়, জনস্বার্থে । সড়কে যাত্রী-শ্রমিক সবাই নিরাপদ থাকবেন, এটাই তাঁর চাওয়া।

শাজাহান খান ‘বেকুব’ বলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চনকে। ইলিয়াস কাঞ্চন সত্যি সত্যি বেকুব। বেকুব না হলে কেউ নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না। ইলিয়াস কাঞ্চন যতই আন্দোলন করুন না কেন, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত স্ত্রীকে আর ফিরে পাবেন না। তারপরও তিনি আন্দোলন করছেন সব সড়কে মানুষের নিরাপত্তার জন্য। এই আন্দোলনের জন্য তিনি বিদেশি কোনো সংস্থা থেকে কোনো অর্থ নেননি। নিজের গাঁটের পয়সায় আন্দোলন করছেন। অতি বুদ্ধিমানের দেশে বেকুবেরাই এ ধরনের কাজ করে থাকেন। অতি বুদ্ধিমানেরা একই সঙ্গে মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা হতে পারেন। দলীয় মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে দর-কষাকষিও করতে পারেন।
অতি বুদ্ধিমানদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশ এখন প্রায় বিপর্যস্ত। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো দু-একজন ‘বেকুবের’ ভীষণ প্রয়োজন, যাঁরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন। প্রবলের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সমাজে বেকুবের সংখ্যা আরও বাড়ুক।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]