সমাজ কেন এমন হলো?
‘আমার ছেলেকে কেন জানে মারল। পঙ্গু করে দিলেও তো আমার বুক আগলে থাকত,’ রিফাতের মায়ের এই অসহায় আকুতি প্রমাণ করে, আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দূরের কথা, তাদের কাছে নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পরিবেশে বাস করছি। এতই অসহায় যে বলছি, তোমরা জানে মেরে ফেলো না, পঙ্গু করে হলেও কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখো।
গুম হয়ে যাওয়া মা-বাবারাও আবেদন করে যাচ্ছে আমাদের সন্তানের লাশটুকু অন্তত ফেরত দাও।
হত্যা–খুন আগেও হতো। তবে তখন তা হতো গোপনে, নির্জনে বা ভাড়াটে খুনি দিয়ে। অপরাধীরা প্রকাশ্য হতে ভয় পেত। পুলিশে ধরবে, গণপিটুনি খাবে, চিহ্নিত হলে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে। কিন্তু এখন চিত্র পুরো উল্টো হয়ে গেল কেন? সাধারণ মানুষ কেন অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে আছে না? মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত বলছেন, এটি সমাজের ব্যর্থতা। কেন সমাজ ব্যর্থ হচ্ছে?
এককথায় এর উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি বোঝা যায় প্রথম আলোর হেডলাইন থেকে, ‘বহু অভিযোগ নিয়ে ও তারা দাপিয়ে বেড়াত’। মাদক বিক্রি, সেবনসহ আগেও কোপানোর ইতিহাস রয়েছে তাদের। তারা বহু মামলার আসামি ছিল। এমনকি পুলিশ অফিসারের বাসায় তাণ্ডব চালানোর মতো ‘বীরত্বসূচক’ কৃতিত্বও তাদের রয়েছে। অপরাধের বহু রকম ‘বিজয়মুকুট’ তারা ইতিমধ্যে অর্জন করে ফেলেছে।
ফলে, প্রকাশ্যে কোপানো সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা চলছে। চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কোপানোর এই বর্বরতার উৎস কোথায়?
আমরা হয়তো কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারব, কিন্তু সমাধান যাদের হাতে, তাদের সেটি করতে বাধ্য করবে কারা? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
কারা এর জন্য দায়ী, গলদ কোথায়, প্রতিকার কী?
এ আমার, এ তোমার পাপ।
কেউই এর দায় এড়াতে পারি না। পরিবার, সমাজ, প্রতিবেশী, রাষ্ট্র, সর্বোপরি রাজনীতি—সবাইকে এর কোনো না কোনো অংশের দায় নিতে হবে।
পরিবারের কথায় আসি:
তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে
আমার পরিবারে এমন পশু, দানব কীভাবে সৃষ্টি হলো? এমনকি পাঁচ লাখ টাকার মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার পরও নতুন মডেলের আরেকটি মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় মা-বাবা উভয়কে পুড়িয়ে মারে?
গোকুলে এমন পিশাচ কেমনে তৈরি হলো?
সন্তান কি এক দিনে বখে যায়? নাকি আমাদের সন্তান প্রতিপালন পদ্ধতিতে রয়েছে বড় গলদ?
প্রথমত, বুঝলাম কোনোভাবে কোনো সন্তান বখে গেছে, বিপথে চলে গেছে, কিন্তু তার বখাটেপনা, অনৈতিক, অসামাজিক, এমনকি অপরাধমূলক কাজগুলোও কি আমাদের নজরে পড়বে না? এতই ব্যস্ততা, নাকি উদাসীনতা আমাদের?
যে ঘাতক আমাকেও বধিবে, তার কি কোনো পূর্বাভাসই আমরা দেখতে পাই না? তত্ত্বাবধান, নজরদারিতে কি তাহলে বড় গলদ রয়েছে?
মাদকাসক্ত ছেলে বা মেয়ে একসময় নিজের মা–বাবাকেই খুন করে ফেলতে পারে, তার এত দিনের বেপরোয়া, সহিংস উন্মাদনা দেখেও কি আমরা অনুধাবন করতে শিখিনি? অভিভাবক হিসেবে আমি কিছুই জানি না—এমনটি হওয়া কি স্বাভাবিক? নাকি টের পেয়েও সন্তানের ক্ষমতা, দাপট দেখে আরও গর্ব অনুভব করছি। প্রতিবেশীরা আরও সমীহ করে চলে যে অমুকের বাপ ‘সম্মান দিয়ে চলো’। দেখে বুকের ছাতি বড় হয়ে যাচ্ছে?
নাকি মূর্খ ছেলে কিছু না করেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ‘উপার্জন’ করছে দেখে সন্তানের অভাবিত ‘উন্নতিতে’ উৎসাহ বোধ করছি? নাকি সন্তানকে বাগে আনতে পারছেন না?
বখে যাওয়া ছেলেগুলো যখন মাদক নেয়, তখন তাদের বোধ–বুদ্ধি–বিবেচনাবোধ সব হারিয়ে ফেলে। তারা তুচ্ছ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যেকোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।
এই ছেলেমেয়েগুলো তো এ এলাকারই সন্তান। যত কুকর্ম, অপকর্ম করে বেশির ভাগ তো নিজ এলাকায়ই করে। মাদক কেনাবেচা, ইভ টিজিং, প্রেমের প্রস্তাব, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, খুনখারাবি—সবই তো কোনো না কোনো সমাজেই ঘটছে?
‘সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধের’ কথা আমরা অহরহ বলছি। কিন্তু সমাজ কি মরে গেছে, নাকি পচে গেছে? সবকিছুই ভেঙে পড়ছে কেন? এসব অপরাধ কি কালেভদ্রে একটি–দুটি ঘটে, না প্রায়ই ঘটে? এসবই কি খুব গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটে, না অনেক ঘটনা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটে?
তাহলে প্রতিরোধের উদাহরণ কোথায়?
আগে এই সমাজে ছোটখাটো অপরাধ, ঝগড়া-বিবাদ বা কোনো অনাচার হলে স্থানীয় মুরব্বিরা বিচারসভা বসাতেন। বিবেকবান মুরব্বিরা পারিবারিক–সামাজিক সংকটগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দিতেন।
এখন তেমন ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ তো নেই, বরং যা আছে সেখানে গোষ্ঠী, পরিবার, দলপ্রীতির সভা হয়। ক্ষমতাবানেরা পার পেয়ে যায়, প্রশ্রয় পায়। দুর্বলদের ওপর শাস্তি বা বদনাম দেওয়া হয় (তোমার মেয়েকে সামলাও, তার চরিত্র ঠিক করো)। অথবা বিচারের নামে অবিচার করা হয়, সালিসের নামে, ফতোয়ার নামে দুর্বলদের ওপর অমানবিক শাস্তি দেওয়া হয়।
সবই হয় ‘ক্ষমতার’ ইকুয়েশন বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়ত, চোখের সামনে অপরাধ ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেন না প্রতিরোধ করতে।
কেউ আসেন না ভয়ে নিজে আক্রান্ত হবেন বা পরে টার্গেট হবেন—এই আশঙ্কায়।
কেউ ভয় পান পুলিশের ঝামেলার কথা মনে করে।
দু–একজন সাহস করে এগিয়ে এলেও তার খেসারত দিতে হয় বিভিন্নভাবে (বদরুল আগেও একবার খাদিজাকে প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করার সময় কিছু লোক তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে সে ওই লোকদের বিরুদ্ধে মামলা করে, পুলিশ ওই উদ্ধারকারীদের হয়রানি শুরু করে, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয়)।
বুঝুন ঠেলা। যান সমাজসেবা করতে, অপরাধ দমন করতে। মানবাধিকার সংস্থা, নারীবাদী সংগঠনগুলো তখন কী ভূমিকা নিয়েছিল? এভাবে কি ওই অপরাধী আরও উৎসাহ পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি?
ভালো মানুষগুলোর অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়নি? তাঁরা কি আবার এ রকম অন্যায়ের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে উৎসাহ বা সাহস পাবেন?
লক্ষ করলে দেখবেন, পথেঘাটে, হাটেবাজারে, যানবাহনে এ রকম অনেক অন্যায় কাজ হচ্ছে। আমরা বেশির ভাগ ভদ্রলোক(?) এগুলো না দেখার ভান করি। গা বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে যাই।
এ রকম ছোটখাটো অন্যায়, অপরাধ প্রতিরোধ অন্তত সমাজ, গণমানুষ যদি করতে সক্ষম হতো, তাহলে অনেক অপরাধ কমে আসত।
কিন্তু প্রকাশ্যে দায়ের সামনে দাঁড়ানোর কথা যাঁরা বলেন, তারা নিজেরা ওই অবস্থায় কী করতেন?
কেন সমাজ এমন হলো?
একটি জীবন্ত, প্রাণবন্ত, মানবিক সমাজের তো এমন হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্নের উত্তর যেমন জানতে হবে, একে বদলানোর উপায় বের করা আরও জরুরি।
পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা:
অপরাধের পেছনে আপনার আমার যত দায় থাকুক, অবশেষে অপরাধ দমন, গ্রেপ্তার, আইনের কাছে পৌঁছানোর সাংবিধানিক দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার।
সঠিক আসামিকে দ্রুত ধরার, নিরপরাধীকে হয়রানি না করা, সৎভাবে দ্রুত চার্জশিট দেওয়া—কোন দায়িত্বটি সঠিকভাবে হচ্ছে? নুসরাতকে বরং উল্টো ওসি মোয়াজ্জেম কী হয়রানিটা করল?
ঢালাওভাবে সব পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ঠিক হবে না এটা ঠিক, তবে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন নেই—এমন লোক পাওয়া কঠিন।
কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক সঠিক দায়িত্ব পালন তো করছেন না, বরং অপরাধীদের সহযোগিতা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ?
টাকাপয়সার লেনদেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নৈতিক মানের অবনতি, কম বেতন, ট্রেনিংয়ের অভাব?
কারণ অনেক হতে পারে, তবে সমাধান খুঁজতে হবে এখনই।
রাজনীতি
এ বিষয়ে কথা বলা ঝুঁকির বিষয়। তার মানে সকল ক্ষমতার উৎস রাজনীতি।
তাই সব উৎসাহ, অনুপ্রেরণার উৎস রাজনীতি এবং সব ভয়ের ও উৎস রাজনীতি।
এতক্ষণ যাদের বিভিন্ন ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বললাম, তাদের ক্ষমতা নিমেষে হারিয়ে যাবে যদি রাজনীতি পরিশুদ্ধ হয়।
প্রতিটি অপরাধকে ‘রাজনৈতিকীকরণের’ ফলে অপরাধ আর স্রেফ অপরাধ থাকছে না; তা রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। তাই পুলিশ ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের সুযোগ সীমিত হয়ে আছে।
সবশেষে রিফাতের স্ত্রী মিন্নির সাহসিকতা ও স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রশংসা না করলে আমরা নিজেরা অপরাধী হয়ে থাকব। যারা মাদকাসক্ত ও বখে যাওয়া, তারা জোর করে মিন্নিদের মতো বহু সুন্দরী মেয়েকে বাধ্য করে তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে বা ঘুরে বেড়াতে। একসময় তাদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে তারা ও তাদের অভিভাবক দ্রুত অন্যত্র বিয়ে দিয়ে থাকেন। কিন্তু এদের কি শেষ পর্যন্ত সমাজ বা রাষ্ট্র রক্ষা করতে পারছে?
ডা. তাজুল ইসলাম: প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
[email protected]