নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে। পুরস্কার ঘোষণার সময় তারা ঘোষণা দিয়েছে, খাদ্যাভাবের ঝুঁকিতে থাকা অথবা ক্ষুধার্ত লাখো–কোটি মানুষের দিকে তারা বিশ্বের নজর ঘোরাতে চায়। খাদ্যাভাবের ঝুঁকিতে থাকা অথবা ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এবং এর জন্য বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থার অকার্যকারিতা বহুলাংশে দায়ী।
কোভিড–১৯–এর আগেও বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল। প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ ছিল গুরুতর খাদ্যাভাবে। ২০২০ সালে যে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কারণ, এ সংকট আংশিকভাবে হলেও খাদ্য সরবরাহব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেছে। তবে এ অবস্থার জন্য ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে জীবিকা বন্ধের হার বৃদ্ধি বেশি দায়ী।
দুর্ভাগ্যবশত আফ্রিকা ও অন্য যেকোনো জায়গায় খাদ্যনিরাপত্তার উন্নয়নের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র চাষিদের আয় না বাড়িয়ে বৈশ্বিক কৃষি ব্যবসার ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। এতে চাষাবাদব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠছে
এ পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা যেত। এখনো সম্ভব। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ক্ষুধা দূরীকরণের কথা রয়েছে। এ লক্ষ্য (এসডিজি–২) প্রকৃতপক্ষেই অর্জনযোগ্য। পৃথিবী তার সব মানুষের জন্য মূল পুষ্টি চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করছে। কিন্তু বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা মহামারির বেশ আগেই ভেঙে পড়েছে। বেশির ভাগ খাদ্য উৎপাদনই টেকসই নয়।
বিশ্ব এসডিজি–২ অর্জনের পথে না থাকার অন্যতম কারণ হলো নীতিনির্ধারকদের সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারা। টেকসই খাদ্য উৎপাদন ও সমভাবে বণ্টনের চেয়ে তাঁরা জোর দিয়েছেন কম খরচে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থা আরও ‘কার্যকর’ করার দিকে। ফলে কৃষি–বাস্তুসংস্থান এবং স্থানীয় পুষ্টি চাহিদা উপেক্ষিত হচ্ছে, রাসায়নিকভিত্তিক কৃষির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি।
এটি অ্যালায়েন্স ফর আ গ্রিন রেভল্যুশন ইন আফ্রিকার (এজিআরএ) উদাহরণ হতে পারে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং রকফেলার ফাউন্ডেশনের এ উদ্যোগের যাত্রা শুরু ২০০৬ সালে। এজিআরএর কর্মসূচি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশককে সমর্থন করে। এজিআরএর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল উৎপাদনশীলতায় উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে আফ্রিকার দুই কোটি কৃষক পরিবারের আয় ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করা এবং ২০টি দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। এরপর এ কর্মসূচি ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ উৎপাদন এবং তিন কোটি কৃষক পরিবারের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিল। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসার মধ্যেই এজিআরএ তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেছে। এখন তারা আফ্রিকার ১১টি দেশে ২০২১ সালের মধ্যে তিন কোটি ক্ষুদ্র চাষি পরিবারের আয় বৃদ্ধি (অনির্ধারিত পরিমাণে) ও খাদ্যনিরাপত্তার উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েছে। সমালোচনার মুখে এজিআরএ সম্প্রতি দাবি করেছে, তারা ৯০ লাখ কৃষকের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং বাকি ২ কোটি ১০ লাখ কৃষকের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে লক্ষ্য অর্জন করতে চায় (যদিও বিষয়টি পরিষ্কার নয়)।
তবে নিরপেক্ষ গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ওই কর্মসূচির ফলে ক্ষুদ্র চাষিদের আয় বৃদ্ধিও পায়নি, খাদ্যনিরাপত্তাও ততটা নিশ্চিত হয়নি। বরং এজিআরএ যে দেশগুলোতে সক্রিয়, সেসব দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। (এজিআরএ এ গবেষণাকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করলেও নিজেদের দাবির পক্ষে কোনো তথ্য দেয়নি)। গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিকর ও জলবায়ু–সহনশীল প্রচলিত ফসল উৎপাদন বাদ দিয়ে ওই সব দেশে ‘উচ্চফলনশীল’ ভুট্টার চাষে জমির ব্যবহার হচ্ছে। এতে কৃষকদের বেশি দামে বীজ কিনতে হচ্ছে, তাঁদের ঋণ বাড়ছে। রাসায়নিকের উচ্চ ব্যবহারে মাটির অম্লতা বাড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে বাস্তুসংস্থানজনিত সমস্যা, যা ভবিষ্যতে চাষাবাদকে বাধাগ্রস্ত করবে।
মালয়েশীয় অর্থনীতিবিদ জোমো কুয়াম সুন্দরম বলেছেন, সবুজ বিপ্লব (গ্রিন রেভল্যুশন) আসলে ত্রুটিপূর্ণ একটি কর্মসূচি। কারণ, তারা পুষ্টিকে সার্বিক ক্যালরি চাহিদার অংশ হিসেবে দেখে। মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে আমাদের টিকে থাকার কৌশল শেখার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আফ্রিকা ও অন্য যেকোনো জায়গায় খাদ্যনিরাপত্তার উন্নয়নের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র চাষিদের আয় না বাড়িয়ে বৈশ্বিক কৃষি ব্যবসার ওপর তঁাদের নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। এতে চাষাবাদব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● জ্যোতি ঘোষ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের সদস্য