ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে সবার নজর পশ্চিমবঙ্গের দিকে। ভারতের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই প্রান্তিক। লোকসভা নির্বাচনের সময় সবার নজর থাকে প্রধানত উত্তর প্রদেশসহ হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোর দিকে। কারণ, সেখানে সম্মিলিত আসনসংখ্যা অনেক বেশি। ফলে ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে যে রাজনৈতিক দল বা জোট জয়ী হয়, তারাই কেন্দ্রে সরকার গড়ার লড়াইয়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকে।
সার্বিক চিত্রটা বোঝাতে এটুকু মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই উত্তর প্রদেশের মোট ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টি পেয়েছিল, তার সহযোগী দল পেয়েছিল ২টি। তেমনই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও ছত্তিশগড়ের সিংহভাগ, অর্থাৎ উত্তর ভারতের সিংহভাগ আসন জিতে সরকার গড়া নিশ্চিত করে ফেলেছিল।
মনে রাখতে হবে, ৫৪৩টি আসনবিশিষ্ট লোকসভায় বিজেপি একার শক্তিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মোট ভোটের মাত্র ৩২ শতাংশ তাদের ঝুলিতে পড়েছিল। অর্থাৎ বিরোধীদের ভোট ভাগ হওয়ায় বিজেপি লাভবান হয়েছিল। কিন্তু উত্তর প্রদেশে বিজেপির প্রধান দুই বিরোধী শক্তি মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি ও মুলায়ম, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি জোট করে লড়ায় সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে।
উত্তর প্রদেশ থেকে এবং তার সঙ্গে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির আসন অনেকটাই কমার সম্ভাবনা। ফলে বাধ্য হয়েই বিজেপিকে তাকাতে হচ্ছে অন্যত্র। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশার দিকে। আসনসংখ্যার বিচারে উত্তর প্রদেশ (৮০), মহারাষ্ট্রের (৪৮) পরই পশ্চিমবঙ্গের (৪২) স্থান। পশ্চিমবঙ্গে গত নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। আর বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা ও ঝাড়খন্ড—পূর্ব ভারতের এই চার রাজ্যের মোট আসন ১১৭টি, তার মধ্যে গতবার বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৪৬টি। তাই এবার এই এলাকা থেকে আসন বাড়াতে বিজেপি পরিকল্পনা করেই ঝাঁপিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব বাড়ার আরও কারণ আছে। বিজেপি জানে, দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে লাখ লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল, তাদের অনেকেই প্রথমে উদ্বাস্তু শিবিরে, বিভিন্ন জবরদখল কলোনিতে আশ্রয় নিলেও সিংহভাগই বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর পশ্চিমবঙ্গের ১০টি জেলায় গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে। এদের বেশির ভাগই দরিদ্র, কৃষিজীবী বা তাঁতি, মত্স্যজীবী বা অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত। ছিন্নমূল এই মানুষদের জীবনে গত ৭০ বছরে পরিবর্তন কিছুটা এলেও ভিটেছাড়ার তিক্ত স্মৃতি মনে থেকে যায়।
বিজেপি এই জায়গাটাতেই সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মধ্যে শিকড় গাড়ছে বহুদিন ধরে। বিভিন্ন সময়ের ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাদের সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে তাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলার চেষ্টাও রয়েছে। যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকার রাজ্যের মুসলমানদের উন্নয়নের নামে প্রথমেই শুধু সরকারি কোষাগার থেকে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন, তখন তা হিন্দু উদ্বাস্তুসহ হিন্দু সমাজের একাংশের চোখে ভালো ঠেকে না। বিজেপি এখানেই ঘৃতাহুতি দিতে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে যে ফাটল রয়ে গেছে, তা আরও বাড়িয়ে মেরুকরণের চেষ্টা করে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বারবার বক্তৃতায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলতে গিয়ে রাজ্যের গোটা মুসলমান সমাজের দিকেই ইঙ্গিত করে দেশের আর্থিক, সামাজিক ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার প্রচার চালিয়ে ওই মেরুকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এবারের নির্বাচনে দেশের অন্যত্র, বিশেষ করে উত্তর ভারতে বিজেপি অনেকটাই কোণঠাসা হলেও পশ্চিমবঙ্গে শক্তি বৃদ্ধি করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ একটা কারণ হলেও সেটাই সব নয়। বাম জমানার অবসানের পরের সাত বছরের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে ফেলেছে। শাসক দলের লাগাতার আক্রমণের মুখে বিরোধী বামপন্থী ও কংগ্রেস এতটাই ছত্রভঙ্গ যে তাদের নেতা ও কর্মীদের মনোবল প্রায় তলানিতে। বহু নেতা-কর্মী গত সাত-আট বছরে দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তৃণমূলের আক্রমণে রাজ্যের বহু জায়গায়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সিপিএম পার্টি অফিস তালাবদ্ধ।
গ্রামাঞ্চলে এই আধিপত্যের জেরে শাসক দলের কাছে বিরোধীদের সম্পূর্ণ রূপে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়, না হলে গরিব মানুষদের রেশনের চাল, বিপিএল কার্ডের সুবাদে সরকারি অন্যান্য সুবিধা, যেমন সরকারি উদ্যোগে ১০০ দিনের কাজে রোজগার, স্বাস্থ্য কার্ড, কৃষিঋণ, শস্যবিমা—সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলে শাসক দলের নিচুতলার নেতাদের লাগামছাড়া দুর্নীতি, গরিব মানুষকে তাদের শ্রমের আয় থেকে টাকার ভাগ দিতে বাধ্য করা—এসবই মানুষ দেখছে।
এ অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেও মানুষ যে তলে তলে ফুঁসছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে উপযুক্ত জঙ্গি রাজনৈতিক দলের আশ্রয় পেলে। সিপিএম ও কংগ্রেস শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের হয়ে রাজনৈতিক লড়াই করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। তাই বিজেপি এসে তৃণমূলের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে সংঘর্ষের পথে গেলে মানুষ তার দিকে সরে যেতে শুরু করে। এভাবেই উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে চা-বাগান এলাকায় আদিবাসী শ্রমিক, বীরভূমে, বর্ধমানের একাংশে, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার একাংশে, ঝাড়গ্রামে জঙ্গলমহলে আদিবাসীরা প্রথমে তূণমূল কংগ্রেস ও বিরোধী বামদের ছেড়ে বিজেপির দিকে সরেছে। যার ফলে, গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি আদিবাসী এলাকায় ভালো ফল করেছে। এখন রাজ্যের অন্যত্রও বিজেপির প্রভাব দ্রুত বাড়ছে।
বিজেপির এই আগ্রাসী মনোভাবের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান সমাজের মধ্যেও মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রধানত সিপিএম থেকে যে হারে কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপির দিকে সরছেন, তা রাজ্যের রাজনীতিকে ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক