সবার আগে জীবন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী এখনকার মতো এমন ভয়াবহ দুর্যোগ আর প্রত্যক্ষ করেনি যা থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। প্রাণঘাতী ভাইরাস কোভিড-১৯ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশকে যেমন বেশি কাবু করেছে, আমাদের মতো তুলনামূলকভাবে দুর্বল দেশকেও রেহাই দেয়নি। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে মারা গেছে চার লাখেরও বেশি মানুষ আর আমাদের দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। আমরা কেউ জানি না কবে আমরা এ অতিমারি থেকে নিস্তার পাব।
জীবন থেমে থাকে না। রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আরও বেশ কয়েক মাস যে এ ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবন ও জীবিকা চালিয়ে যেতে হবে সেটা সবাই বুঝতে পারছি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ জীবিকার। ক্ষুধার কষ্ট রোগের ভয় মানে না। তাইতো দেখি খেটে খাওয়া মানুষেরা, স্বল্প আয়ের সবাই বেরিয়ে পড়েছেন সবকিছু অগ্রাহ্য করে। তবে দুঃখ লাগে যখন শিক্ষিত জন, যাদের সুযোগ আছে সাবধানী হওয়ার, তারাও কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানার তোয়াক্কা করেন না। এ যেন লাল বাতি অগ্রাহ্য করে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মতো দাপট দেখানো।
কিছুদিন ধরেই পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি শিল্পীরা তাঁদের আগামী দিনের কাজের পদ্ধতি ও সম্ভাবনা নিয়ে নানা মতামত ব্যক্ত করছেন। তার পাশাপাশি শুরু থেকেই আমরা দেখছি, অনেক শিল্পী ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে অভাবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। নাটকের দল, নাচ-গান-আবৃত্তির সংগঠন নিজেদের মতো করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ত্রাণকাজ পরিচালনা করছে। এর একটাই কারণ আমরা শিল্পচর্চা করি মানুষের জন্য। মানুষই যদি না বাঁচে, তবে কার কাজে আসবে আমাদের শিল্পকর্ম?
একটা কথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, মঞ্চনাটকের শিল্পীরা এ পেশা থেকে কোনো অর্থ উপার্জন করতে পারেন না, উল্টো গাঁটের পয়সা খরচ করে নাটক চালিয়ে যান। অল্প কয়েকজন পেশাদার নেপথ্যকর্মী সামান্য কিছু অর্থ মঞ্চনাটক থেকে উপার্জন করে থাকেন। আমাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন জীবিকা আছে যদিও সে ক্ষেত্রেও নেমে এসেছে সংকট, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছি আমরা।
অনেকেই অস্থির হয়ে গেছেন, কবে থেকে আবার নাটক শুরু করা যাবে। তাদের অবগতির জন্য জানাই ১৬০৩ থেকে ১৬১৩ সাল পর্যন্ত মহামারি প্লেগের কারণে লন্ডনের নাট্যশালাগুলো যত দিন বন্ধ ছিল, তার সবগুলো দিন যোগ করলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮ মাস। তাতে নাটকের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। এ সময়েই শেক্সপিয়ার লন্ডন ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি যেতে বাধ্য হন। সেখানে বসে রচনা করেন চিরায়ত সব নাটক।
আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় নাট্যদলগুলো এখন কয়েকটি কাজ করতে পারে। এক, এখন সুযোগ এসেছে নিজেদেরকে তৈরি করার, বাচিক অভিনয়ের চর্চা করা, গানের শিল্পীরা যেমন নিয়মিত রেওয়াজ করেন। নাট্যকাররা নতুন নাটক লিখতে পারেন, নির্দেশকেরা আগামী প্রযোজনা নিয়ে ভাবতে পারেন। দুই, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মানুষের পাশে দাঁড়ানো। অতীতে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংস্কৃতিকর্মীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেছেন। এবারও নিজ নিজ এলাকায় আমরা তা করতে পারি। অনেকে অবশ্য শুরু থেকেই সাধ্যমতো কাজ করে চলেছেন।
এই মুহূর্তে কয়েকটি উদ্যোগের কথা মনে আসছে। কলেজ শিক্ষিকা ও গবেষক জেসমিন বুলি গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম জেলার তৃণমূল পর্যায়ের লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন। এ তিন জেলার সাড়ে তিন শ শিল্পীর ফোন নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা করে পাঠানো হয়েছে। তাঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে আসাদুজ্জামান নূর, মফিদুল হক ও আমি যুক্ত হয়ে পরিচিতজনের কাছ থেকে আমরা অর্থ সংগ্রহ করেছি। ‘লোক-শিল্পীর পাশে আমরা’ এই উদ্যোগে তাঁদের কাছ থেকে বিনিময়ে ফোনে তাঁদের কাজের ভিডিও নমুনা পেয়েছি যা দিয়ে গড়ে উঠতে পারে এক মূল্যবান সংগ্রহশালা।
মাদল-এর মেহেদী মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী এক লাখ লোককে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার যে অভাবনীয় কর্মসূচি নিয়েছেন, তাতে অর্থ সাহায্য করার মানুষের অভাব হয়নি। মেহেদী তো এ কাজ করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জামালপুরের ‘আমরা ফাউন্ডেশনের’ ৩০ জন তরুণ পাঁচ টাকার বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের মাঝে খিচুড়ি-মুরগির মাংস খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের কয়েকটি জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনের কাজ তো রয়েছেই।
তিন, আরও কয়েক দিন গেলে আমরা উপযুক্ত স্থানে পথ নাটক মঞ্চায়ন করতে পারি। সেখানে অভিনেতা ও দর্শকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানা সম্ভব হবে। নাটকের বিষয় হতে পারে সচেতনতামূলক অথবা নিছক বিনোদন।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে থিয়েটার হলে নাটক করার চিন্তা বাদ দেওয়া যেতে পারে। ৫০০ দর্শকের জায়গায় ১০০ দর্শক বসিয়ে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করা গেল। কিন্তু অভিনেতারা কী সবাই মাস্ক পরে ৩ ফুট দূরে দূরে থেকে অভিনয় করবেন? দেড়-দুই ঘণ্টা বন্ধ ঘরে থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। ছয় মাস পর পরিস্থিতি অনুকূল হলে, নাটকে আবার দর্শক আসবে। তবে নাটকের মধ্য দিয়ে নতুন পৃথিবীর কথা বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের নাটকের চেহারা বদলে দিয়েছিল, এবারের অতিমারিও নাটকের বাঁক বদল করাবে। দর্শক আমাদের সৃষ্টিশীলতার পরীক্ষা নেবে।
ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাটক নিয়ে আমরা যে সব কর্মকাণ্ড করছি, তাতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চা কিছু হচ্ছে না। তবে শিক্ষামূলক কিছু কাজ নাট্যকর্মীদের উপকারে আসবে। অর্থহীনভাবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করার কোনো প্রয়োজন নেই। বর্তমান সংকটকালে সংস্কৃতির বাজেট বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার চেষ্টা করি। সমাজের শক্তিকে কাজে লাগাই।
তাই আবারও বলি, সবার আগে জীবন। বেঁচে থাকলে আবার সব হবে। প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা মনে রেখে আমরা নতুন পৃথিবীতে আরও মানবিক হব, ধরিত্রীর প্রতি যত্নশীল হব। সুন্দর আগামী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।