এশিয়ার অনেক দেশের উন্নয়নবিষয়ক কল্পনায় সিঙ্গাপুরের অনন্য আবেদন আছে। এখানকার অনেক উন্নয়নশীল দেশ সিঙ্গাপুরের মতো ঝাঁ–চকচকে শহর গড়তে চায়। নগর-রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সার্বিক বিবেচনায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এশিয়াভুক্ত এই দেশ কোনো ঔপনিবেশিক বা নব্য উপনিবেশবাদের নীতিতে না হেঁটে সম্পূর্ণ নিজস্ব নীতিতে এগিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে সত্যিকারের অভিনন্দন সিঙ্গাপুরের প্রাপ্য। দেশটির সার্বিক সাফল্য এতটাই অনন্য যে এশিয়ার অনেক দেশের সরকার তাদের জনগণকে প্রায়শই তাদের বিদ্যমান কোনো শহর, উপশহর এমনকি গ্রামকেও ‘সিঙ্গাপুরে’ রূপান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।
এশিয়ার কিছু দেশ চীনের প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়নে সহযোগিতা দেওয়ার বিনিময়ে দেশটির কাছ থেকে তহবিল নিয়ে নিজ নিজ ভূখণ্ডে সিঙ্গাপুরের মতো শহর গড়তে চাচ্ছে। মিয়ানমারের কথাই ধরুন। দেশটির রাখাইন প্রদেশের কিয়াউকপিউ বন্দর গড়ার সময় এটিকে ভবিষ্যতের ‘মিনি সিঙ্গাপুর’ বলা হতো। বর্তমানে কিয়াউকপিউ থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত দুটি পাইপলাইন গেছে। একটি তেলের আরেকটি গ্যাসের। মিয়ানমারে তীব্র জ্বালানিসংকট থাকার পরও এই বন্দর হয়ে কুনমিংয়ে যে গ্যাস ও তেল যায়, তার কোনো অংশই মিয়ানমারে যায় না। অবশ্য এই পাইপলাইনের জন্য মিয়ানমারকে চীন নিয়মিত রয়্যালটি দিয়ে থাকে। এই এলাকায় এখন একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এবং একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হবে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই দুটি প্রকল্পের ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকবে চীনের বিনিয়োগকারীদের হাতে।
সিঙ্গাপুর কারও কাছ থেকে চড়া সুদে ধার এনে বা বাইরের দেশের ব্যবস্থাপত্রমাফিক নীতি ঠিক করে তাদের উন্নয়নকাজ করেনি। নিজস্ব সম্পদ ও লোকবল দিয়ে কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে সারা দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করা যায়, সেই পরিকল্পনা ধরে তারা এগিয়েছে। সিঙ্গাপুরের সব ধরনের বিশ্বাসের মানুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠাকে তারা সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে নিয়েছে।
মিয়ানমারের সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার সে সময় এই ভেবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যে এসব প্রকল্পের কাজে চীনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ধার করতে হবে এবং তা শোধ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সিঙ্গাপুর শহর আন্তর্জাতিক সমুদ্র যোগাযোগব্যবস্থার খুব কাছে। কিন্তু কিয়াউকপিউ বন্দর থেকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র যোগাযোগ অনেকটাই দূরে থাকবে। এটি মূলত ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মধ্যে যোগাযোগ ও পরিবহনে ভূমিকা রাখবে। তবে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার কারণে কিয়াউকপিউ বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা একেবারে কমে গেছে।
পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা প্রায় বলে থাকেন, দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশের গোয়াদর শহরটির আরও ১০ বছর আগে নাকি সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত হওয়া উচিত ছিল। তাঁরা বলছেন, অতীতের এই ভুলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন সেখানে তাঁরা একটি গভীর সমুদ্র বন্দর, একটি এসইজেড এবং একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরির প্রায় সব কাজই করবে চীন। গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে চীনা কোম্পানিগুলোকে সেখানকার বিস্তৃত এলাকা ইজারা দেওয়া হবে।
মিয়ানমার ও পাকিস্তানের যে অভিজাত শ্রেণি শহরকে সিঙ্গাপুর বানাতে চায়, তারা নিজেরা সেসব শহরে বাস করে না। আসলে এসব এলাকায় স্থানীয় আদিবাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে শাসক অভিজাতদের দ্বন্দ্ব আছে। বেলুচিস্তান ও রাখাইনের স্থানীয় মানুষ সব সময়ই সংশয় প্রকাশ করে আসছে, তাদের শহর যদি সিঙ্গাপুর হয়, তাহলে সেই উন্নত শহরের সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবেন কি না।
শ্রীলঙ্কাও কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে সিঙ্গাপুরের উচ্চতায় নিতে চায়। সে ক্ষেত্রে তারাও চীনের কাছ থেকে চড়া সুদে অর্থ ধার করে বিশেষ রপ্তানি এলাকা গড়ছে। সেটি বাস্তবায়ন করছে একটি চীনা কোম্পানি। ইতিমধ্যেই চীনের দেনা পরিশোধ করতে না পেরে দেশটির হামবানটোটা বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আদতে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার তাদের ওই সব শহরে বড়জোর ধারের টাকায় সিঙ্গাপুরের মতো কিছু বহুতল ভবন বানাবে। প্রকৃতপক্ষে সিঙ্গাপুর হওয়া তাদের জন্য একেবারেই অসম্ভব।
প্রথম কথা হলো, সিঙ্গাপুর কারও কাছ থেকে চড়া সুদে ধার এনে বা বাইরের দেশের ব্যবস্থাপত্রমাফিক নীতি ঠিক করে তাদের উন্নয়নকাজ করেনি। নিজস্ব সম্পদ ও লোকবল দিয়ে কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে সারা দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করা যায়, সেই পরিকল্পনা ধরে তারা এগিয়েছে। সিঙ্গাপুরের সব ধরনের বিশ্বাসের মানুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠাকে তারা সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু রাখাইন বা বেলুচিস্তান কিংবা কলম্বোয় সে ধরনের আবহ নেই। সেখানে জাতিগত সংঘাত রয়ে গেছে। এ কারণে এসব দেশের শহরগুলোকে ‘সিঙ্গাপুর বানানো’ সম্ভব হবে না।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সঞ্জয় পুলিপাকা ভারতীয় লেখক ও গবেষক