দেশের সর্বত্র যেমন নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, নীতিহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা; সড়ক-মহাসড়ক, গলি-রাজপথেও তারই প্রতিচ্ছবি। যানজট তো আছেই। রাস্তাগুলো ভাঙাচোরা। কোথাও কোথাও ভয়াবহ খানাখন্দক। মহাসড়কেও দেখবেন রাস্তা অসমান, ঢেউখেলানো। একদিকে চলাচলকারী মহাসড়কে দেখবেন অকস্মাৎ বিপরীত দিক থেকে আসছে যান। মসৃণ মহাসড়ক পাওয়া যাবে একমাত্র পদ্মা সেতু অভিমুখী ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে। সে মহাসড়কেও দেখবেন বালকেরা সাইকেল পালা করে রেখেছে, শখের সাইকেল চালাচ্ছে; আর বাইকচালকেরা সঙ্গী-সঙ্গিনীসহ দাঁড়িয়ে টিকটক করছে বা সেলফি তুলছে! কী ভয়ংকর কথা! ৮০ কিলোমিটার সেখানকার গতিসীমা, গাড়ি চলছে ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে; হঠাৎ করে এই বাইসাইকেল আরোহী বা সেলফি-বিলাসীরা সামনে এসে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবেই।
এই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই চালকের দোষ, ধরো গাড়িটাকে, ভাঙো, পোড়াও এবং চালককে দাও গণপিটুনি। উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব যান থেমে যায়, থামার জন্য রাস্তার ধারে ইমার্জেন্সি লেন থাকে; পুলিশে ফোন করা হয়, পুলিশ আসে, অ্যাম্বুলেন্স আসে, উদ্ধারকাজ পরিচালিত হয়, পরে বিচার হয়; অপরাধীর জরিমানা হয়, ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা পড়ে, অনেক পরিমাণ ক্ষতিপূরণও দায়ী ব্যক্তিকে দিতে হতে পারে। আমাদের দেশের বিচার জনতার বিচার, তাৎক্ষণিক এবং ভয়াবহ। ফলে একটা দুর্ঘটনা ঘটা মাত্র সংশ্লিষ্টরা পালাতে শুরু করে, দ্রুত পালাতে গিয়ে আরও দুটো অ্যাক্সিডেন্ট করে বসা বিচিত্র নয়।
তার মানে এই দেশে আইনের শাসন কায়েম হয়নি, আইনের শাসনের ওপরে নাগরিকদের কোনো আস্থাও নেই।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ২ ডিসেম্বর ২০২১-এর প্রথম আলোর খবর, ‘এটা আসলে কাঠামোগত হত্যা’। একই রুটে চলা বিভিন্ন বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে উল্লেখ করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এটা আসলে কাঠামোগত হত্যা। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ট্রাফিক পুলিশের অসাধু সদস্যদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা সড়কে নৈরাজ্যের কারণগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। তবে এটা কেবল পরিবহন খাতে নয়, অন্য আরও অনেক খাতেরই সচরাচর চিত্র এবং সার্বিক অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্যের অংশ মাত্র।
আমাদের দেশে যেকোনো সনদ মানে কিছু টাকা খরচা করা। যখন একটা কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটে, তখন আমরা দেখি, সেই কারখানায় আগুন নেভানোর জন্য প্রস্তুতি নেই, জরুরি নির্গমন পথ নেই, আগুন নেভানোর মহড়া হয় না...ইত্যাদি ইত্যাদি। কারখানা পরিদর্শকের সংখ্যার চেয়ে কারখানার সংখ্যা অনেক বেশি। এত বেশি যে ১০০ বছরেও সব কটি কারখানা পরিদর্শকদের পক্ষে পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। একটা কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য ডজনখানেক সনদ বা অনাপত্তিপত্র লাগে। পরিবেশের সনদ লাগে, অগ্নিনির্বাপণের সনদ লাগে। এই সনদ যাঁর আছে, তাঁর এই বিষয়ে সক্ষমতা আছে, ব্যাপার তা নয়। আসলে তিনি এই সনদের জন্য কিছু টাকা খরচ করেছেন, কিছু বাড়তি বা উপরি টাকাও তাঁকে খরচ করতে হয়েছে।
আমাদের সমাজে যে নৈরাজ্য, তারই ছবি আমরা রোজ দেখি রাস্তায়। একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। আছে পরিকল্পনাহীনতা, সমন্বয়হীনতা! আছে প্রকৌশলগত ব্যর্থতা। আছে প্রকল্প সম্পন্ন করবার দক্ষতার অভাব এবং আছে দুর্নীতি। এক রাস্তা এক শ বার খোঁড়া হয়। এক ফ্লাইওভার একবার গড়ে আরেকবার ভেঙে ক্রমাগত সংশোধন। প্রকল্প তার মেয়াদের মধ্যে শেষ না করে ঝুলিয়ে রেখে ব্যয় বৃদ্ধি করতে থাকা।
গাড়ির বেলাতেও তা-ই। ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে কি না, পুলিশ বা শিক্ষার্থীরা তা পরখ করে দেখতে পারে; কিন্তু গাড়িটি আসলে ফিট কি না, তা দেখার কথা বিআরটিএর। কিন্তু আসলে কি গাড়িগুলো ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই সনদ পায়? নাকি বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে উপরি দিয়ে এই সার্টিফিকেট নেওয়া হয়? রাস্তায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা হলে পুলিশ এসে আপনাকে জরিমানা করতে পারে। করেও। কিন্তু সবটা যে রসিদ দিয়ে সরকারি খাতে জমার জন্য জরিমানা তা নয়! কবীর সুমনের গানে আছে, ‘প্রথম দেখা দিনদুপুরে পুলিশ ঘুষ খায়, প্রথম জানা পয়সা দিয়ে সবই কেনা যায়!’
আমি বলছি না সব ট্রাফিক পুলিশ ঘুষ খায়, বিআরটিএর সব কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ। কিন্তু আপনি বিআরটিএর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিতে যান, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে আপনি কেউটে বের করে ফেলতে পারবেন। আমি বলতে চাইছি, রাস্তায় যে গাড়িগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে, সেসবের ফিটনেস আছে কি না কেউ নিশ্চিত না, যে ভবনের পরিবেশ বা অগ্নিনির্বাপণের সনদ আছে, তারা পরিবেশবান্ধব বা অগ্নিকাণ্ডনিরোধী কি না, তা–ও কেউ জানে না। একইভাবে যাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তিনি যে ড্রাইভিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, রাস্তার আইনকানুন তাঁর জানা, নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি সচেতন, জীবন ও সম্পদের বিষয়ে তাঁর মূল্যবোধ ও সহমর্মিতা আছে, সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। কারণ, ড্রাইভিং লাইসেন্স একটা প্লাস্টিকের কার্ড মাত্র, এটা কিনতে পাওয়া যায়! ওই কার্ডটা আসল নয়, আসল হলো চালকের প্রশিক্ষণ, আসল হলো চালকের দক্ষতা! সেই বিষয়টাই তো উপেক্ষিত। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের দুটো বর্জ্য পরিবহনের গাড়িতে পরপর দুজন মানুষের মৃত্যুর পর দেখা যাচ্ছে আরেক নৈরাজ্যের ছবি। এই গাড়িগুলো চালান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। আসল চালকের কোনো খোঁজ নেই। তিনি হয়তো পদটা আরেকজনকে বিক্রি করে দিয়েছেন।
রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে অনেক অনেক মূল্যবান প্রাণ ঝলসে যাওয়ার পর আমরা হইচই করতে থাকি, আবাসিক এলাকায় বাসাবাড়িতে দাহ্য রাসায়নিকের গুদাম কেন? কারখানায় আগুন লেগে অগণিত শ্রমিকের মৃত্যুর পরে আমরা দেখি, ২০ জনের জায়গায় কাজ করছিলেন ২০০ জন, আর এই ভবন আদৌ কারখানার জন্য নকশাই করা হয়নি। আমরা যেমন নিরাপদ সড়ক চাই, তেমনি নিরাপদ সমাজ চাই, নিরাপদ জীবন চাই।
বলছিলাম, শিক্ষার্থীরা সড়কের সমস্যাটা ঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছে। সমাধানের সুপারিশও তারা ঠিকই করেছে। ফুটওভার ব্রিজ বানানো, ফিটনেসহীন-লাইসেন্সহীন গাড়ি চলতে না দেওয়া, বিআরটিএ ও পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, এক রুটের বাসকে একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে আনা, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, চালক-সহকারীর মাদক পরীক্ষা করা! ছাত্রদের এই দাবি অবশ্যই পূরণ করা উচিত। করা উচিত, করার প্রতিশ্রুতি আগেও পাওয়া গিয়েছিল, এবারও হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কি দুর্নীতি দমন কমিশন আদাজল খেয়ে লাগতে পারে? কিন্তু দুর্নীতি কোন বিভাগে নেই? একটা স্কুলের ঝাড়ুদার নিয়োগে যে দেশে দুর্নীতি হয়, সে দেশে তো সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্যই ঘটবে। তা-ই ঘটছে।
সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ি পোড়ানো সমস্যার সমাধান নয়, বরং তাতে করে আরও আরও জীবন ও সম্পদের ক্ষতি! আবার সড়কে-মহাসড়কে মৃত্যুর জন্য সব সময় চালক দায়ী থাকে না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় মানুষ যে ফুটপাত ধরে চলবে, ফুটপাত কই? সব তো দোকানের বর্ধিত অংশ বা হকারদের দখলে। আপনাকে রাস্তায় নামতেই হবে। উল্টোটাও আছে। ফুটপাত আছে, কিন্তু পথচারীরা ফুটপাত বাদ দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকেন। আর ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও সুস্থ-সক্ষম মানুষ নিচ দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে, কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলছে, এই দৃশ্য তো হরহামেশাই দেখি।
সেই জন্যই বলি, আমাদের সমাজে যে নৈরাজ্য, তারই ছবি আমরা রোজ দেখি রাস্তায়। একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। আছে পরিকল্পনাহীনতা, সমন্বয়হীনতা! আছে প্রকৌশলগত ব্যর্থতা। আছে প্রকল্প সম্পন্ন করবার দক্ষতার অভাব এবং আছে দুর্নীতি। এক রাস্তা এক শ বার খোঁড়া হয়। এক ফ্লাইওভার একবার গড়ে আরেকবার ভেঙে ক্রমাগত সংশোধন। প্রকল্প তার মেয়াদের মধ্যে শেষ না করে ঝুলিয়ে রেখে ব্যয় বৃদ্ধি করতে থাকা।
এসব কি চলতেই থাকবে? না। কোত্থেকে শুরু হবে সেই সংস্কারকাজ! শুরু করতে হবে ওপর থেকে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করতে হবে জাতীয়ভাবে, এবং সার্বিকভাবে, এবং ওপর থেকেই!
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক