সব দুঃখ কি ক্রিকেটেই ভুলবেন?
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। হার-জিত নয়, বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার আনন্দেই তখন আত্মহারা ছিল এ দেশের মানুষ। ওই সময় ক্রিকেট বলতে আমরা ২২ গজের খেলাই বুঝতাম। কিন্তু এখন তা যেন ‘সর্বরোগের দাওয়াই’ হয়ে গেছে!
আমাদের দেশের সমর্থকদের ক্রিকেটবিষয়ক মন্তব্যগুলো বেশ মজার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো যুক্তির ধার ধারে না। বিশ্বকাপের গত ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮২ রানের জয়ের লক্ষ্যেও সদর্পে ছুটেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। পারুক, না পারুক—অন্তত চেষ্টা তো করেছে। তবে ফেসবুক বা চায়ের দোকানে সেই চেষ্টার দাম খুব একটা দেন না সাধারণ ‘ক্রিকেটবোদ্ধারা’। বলা হয়, ‘তামিম-সাকিবরা খেলা পারে না’, ‘এই শট এভাবে খেলা উচিত ছিল’, ‘মাশরাফি তো দৌড়াতেই পারে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনলে প্রথমেই মনে হয়, একজন ক্রিকেট প্রতিভাকে আমরা হেলায় হারাচ্ছি! মিচেল স্টার্কের বল না খেলেও যিনি এত ভালো পরামর্শ দিতে পারছেন, খেললে না জানি কী করতেন!
তবে এখন আর আমরা শুধু নির্দোষ সমালোচনায় সময় কাটাতে চাই না। সেটি প্রায় সময়ই সভ্যতা-ভব্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সেই অভব্য সমালোচনার আগুনে পুড়তে হয় ক্রিকেটারদের পরিবারের সদস্যদের। কারণ, ওই ক্রিকেটার ম্যাচে একটি ক্যাচ মিস করেছে, হয়তো কোনো ব্যাটসম্যান ছক্কা মারার বলে চার মেরেছে। লাসিথ মালিঙ্গা এই বয়সে ম্যাচ জেতালে আমরা আপ্লুত হই ঠিকই, কিন্তু মাশরাফির চেষ্টাকে ন্যূনতম সম্মান দিই না। কারণ, আমাদের যে সব চাই!
এমন নয় যে আমাদের দেশে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো ক্রিকেটের বিশাল বিশাল অবকাঠামো আছে। বাংলাদেশের জয়ের অভ্যাস গড়ে উঠেছে, তাও কিন্তু খুব বেশি দিন হয়নি। ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়। ওই বছর বাংলাদেশ খেলেছিল চারটি ওডিআই, একটিতেও জেতেনি। ২০০১ সালে দুটো ম্যাচ বেশি খেললেও জয় আসেনি। তার পরের দুই বছরেও জয় আসেনি, এর মধ্যে তো হারতে হয়েছিল কানাডার কাছেও। ২০০৪ সালে সেই খরা কাটে। ৯৯-এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর অনেক দিন পর ২০০৪-এ ভারতকে হারিয়ে বড় দলের বিপক্ষে সাফল্য পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৫ সাল থেকে মূলত র্যাঙ্কিংয়ের তলানির দলগুলোর বিপক্ষে নিয়মিত জয় পাওয়া শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এই সময়টাতে টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে আর কথা না বাড়াই। বেশির ভাগ দিনই আমাদের কপালে জুটত ইনিংস ব্যবধানে হার। ইনিংসে না হারলেই আমরা ভাবতাম লড়াই হয়েছে।
অথচ সেই ক্রিকেটেই এখন আমরা বড় বড় দলকে বলে-কয়ে হারাই। গত বছর খেলা ২০টি ওয়ানডের মধ্যে ১৩টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত নিয়মিতই জয়ের দেখা পাচ্ছে বাংলাদেশ, তিন শর বেশি রানের লক্ষ্যও তাড়া করছে। এক কথায় ‘অসম্ভব’ লক্ষ্য পেলেও আমাদের ক্রিকেটাররা ভালোই চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কিছু সমর্থকের ভাব দেখে মনে হয়, ক্রিকেটাররা ইচ্ছে করে খারাপ খেলছে! এমন নয় যে সমালোচনা করা যাবে না। অবশ্যই যাবে। কিন্তু তাই বলে যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে, একজনকে শূলে চড়ানোর গণরায় দেওয়ার কী মানে? মনে রাখতে হবে, বছরের পর বছর ধারাবাহিক পরাজয় দেখে বড় হওয়া সাকিব-মুশফিকেরা কিন্তু নিজের চেষ্টাতেই জয়ের ধারায় পৌঁছেছেন। কোনো শচীন টেন্ডুলকার বা গ্লেন ম্যাকগ্রা তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাননি। আর এবড়োখেবড়ো পথে দৌড়াতে গেলে, হোঁচট তো খেতে হতেই পারে।
এই সমালোচনা বা প্রকারান্তরে প্রতিবাদ কিন্তু সব জায়গায় দেখাই না আমরা। এ দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি, অথচ আয়করের জন্য নিবন্ধিত মোটে ৪০ লাখ। কিন্তু আয়কর দেওয়ার সামর্থ্য কি শুধু এই মানুষদেরই আছে? এর অর্থ, অনেকে কিন্তু জেনেবুঝেই অসৎ উপায়ে দেশকে বঞ্চিত করে চলেছে। এই দেশের লক্ষ কোটি টাকা যখন খেলাপি হয়ে যায়, তখন তার প্রতিবাদ কি আমরা করি? অথবা আপনাদের সামনে যখন বখাটেরা একজন নারীকে উত্ত্যক্ত করে, তখন কি সবাই প্রতিবাদে শামিল হন? আচ্ছা, নুসরাতের হত্যাকারীদের সমর্থনে যখন মিছিল হয়, তখন সেখানে উপস্থিত কয়জন তার প্রতিবাদ করেছিল? অথবা একজন ছিনতাইকারী যখন অন্যের সর্বস্ব লুটে নেয়, তখন কজন প্রতিরোধ করে? আমরা এগুলোতে আগ্রহী নই। কারণ, সুকুমার রায়ের ছড়ায় বলতে গেলে,
‘...ঠাণ্ডা মেজাজ কয় না কিছু,
লাগতে গেছ তারই পিছু ?
শিক্ষা তোদের এম্নিতর
ছি-ছি-ছি! লজ্জা বড়।...’
অবশ্য আমরা এখন শুধু দেশের ক্রিকেটারদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছি না। শুধু দেশ নয়, এখন আন্তর্জাতিক পরিসরেও আমরা আমাদের ‘উগ্র’ মনোভাবের উন্নত উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছি। ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম তা কিছুটা টের পেয়েছেন। বাংলা পড়তে পারলে নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে বুঝতেন। ভাগ্যিস তা হয়নি। হলে জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হতো কি না!
এই যে ক্রিকেটারদের ভুল নিয়ে আমরা হৃদয়ের সব ক্ষোভ উগরে দিই—এত ক্ষোভ আসে কোত্থেকে? আসে নিত্যকার জীবন থেকেই। বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে চড়ার ক্ষোভ, বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারে অত্যাচারিত হওয়ার আর্তনাদ, তুমুল সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাজারে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে কোণঠাসা অবস্থা—এসব থেকেই নাগরিকদের মনে বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ জমা হয়। একসময় তা ক্রোধের সাগরে রূপ নেয়। পরে সেটিই জলোচ্ছ্বাস হয়ে ক্রিকেটারদের ভাসিয়ে নেয়। কারণ, ক্রিকেট বাদে আর কিছুতেই যে মানসিকভাবে ‘জয়ী’ হতে পারছি না আমরা। তাই সাফল্যের অনুভূতি পেতে ‘উগ্র’ হতেও বাঁধছে না আমাদের। এতটাই বুভুক্ষু আমরা।
এমন সর্বনাশা ক্ষোভের পুরোটা ক্রিকেটারদের ওপর না ঢেলে, যথাস্থানে প্রদর্শন করলে কিন্তু ভালো ফল পাওয়া যেত। তাতে নিজেদের পাশাপাশি হয়তো দেশ ও সমাজের কিছুটা মঙ্গল হতো। আর মনে রাখতে হবে, দিন শেষে ক্রিকেট একটা খেলাই, যুদ্ধ নয়। তাই যুদ্ধের আবহ টেনে আনাও সমীচীন নয়। প্রতিবেশীকে যে কারণে গালি দিচ্ছেন, সেই একই অবস্থা যদি নিজেদেরও হয়, তবে আর সমালোচনা করার নৈতিক ভিত্তি থাকে না।
শেষটাতেও সুকুমার রায়ের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। ‘মনের মতন’ ছড়ায় তিনি লিখেছেন,
‘কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ'ল ভূতের মুলুক খুঁজি।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে?
আর কি দিব ?- মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান।’
আসুন, কটু কথা ছেড়ে ক্রিকেট নিয়ে আনন্দে মাতি। আর ক্রিকেটারদের ওপর মানসিক চাপ কমাই। প্রত্যাশার পাহাড়সম চাপ নিয়ে যারা ৩৮১ তাড়া করতে পারে, খেলা উপভোগের স্বাধীনতা পেলে তারা কী করবে—একবার ভেবে দেখবেন!
অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]