পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীরা ভারতে হামলা চালানোর পর আবারও পাকিস্তান ও ভারত মারমুখী অবস্থানে এসেছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত ২২ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। পাকিস্তানভিত্তিক এই সন্ত্রাসীরা প্রতিবেশী দেশ ইরান ও আফগানিস্তানেও একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। এ কারণে পাকিস্তানের ওপর এবার আন্তর্জাতিক চাপটা অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কি শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে?
বহু বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে সংঘটিত হামলার মূল শিকড় পাকিস্তানে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা দেখিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানে মিলিটারি একাডেমির কাছেই কড়া সামরিক নিরাপত্তা ঘেরা শহর অ্যাবোটাবাদে আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন লুকিয়েছিলেন। নাইন– ইলেভেন হামলার অন্যতম হোতা ও আল–কায়েদার তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় নেতা খালিদ শেখ মোহাম্মাদ এবং এই নেটওয়ার্কের অপারেশন চিফ আবু জুবায়দাকেও পাকিস্তানের কেন্দ্রস্থলে পাওয়া গিয়েছিল। এসব ঘটনার জের ধরে পাকিস্তানকে বারবার সন্ত্রাস–সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে বলেছিলেন, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সন্ত্রাস দমন ইস্যুতে আমেরিকার কাছ থেকে পাকিস্তান ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার নিয়েছে। কিন্তু ‘মিথ্যা ও অপকর্ম’ ছাড়া দেশটি কিছুই দেয়নি। ট্রাম্প বলেছেন, যে সন্ত্রাসীদের ধরতে আমেরিকা আফগানিস্তানে অভিযান চালাচ্ছে, সেই সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য এখন পাকিস্তান। প্রয়োজন দেখা দিলে যাতে পাকিস্তানের কাছ থেকে পরমাণু অস্ত্র কেড়ে নেওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা সহায়তা দেওয়াও অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় এক তরুণ জঙ্গির আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ। ওই একই সপ্তাহে দক্ষিণ–পূর্ব ইরানে একটি আত্মঘাতী হামলায় ইরানের ২৭ সেনা নিহত হন। ওই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তানের জইশ-উল-আদল। এ ছাড়া আফগানিস্তানের একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে তালেবান ৩২ জন আফগান সেনাকে হত্যা করে। পুলওয়ামা হামলার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছে। ইরান ইতিমধ্যে পাকিস্তানের ওপর পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ার করে বলেছে, পাকিস্তান ব্যবস্থা না নিলে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে করা সম্ভব নাও হতে পারে।
ভারত ইস্যুতে পাকিস্তানকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দেয় যে দুটি দেশ, সেই চীন ও সৌদি আরবও ইসলামাবাদকে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হওয়ার আশঙ্কায় আছে পাকিস্তান। এতে পাকিস্তানের শুধু ভূরাজনৈতিক ক্ষতি হবে তা নয়, অর্থনৈতিকভাবেও দেশটি গভীর সংকটের মুখে পড়বে। চীন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে জরুরি ঋণ পাওয়ার পরও পাকিস্তান আইএমএফের কাছ থেকে আরও ঋণ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আইএমএফ দেশটিকে আরও ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার
ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করে, তাহলে সে ঋণ তারা পাবে না।
এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ওপর দমনাভিযান চালাবে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খুব একটা আশ্বস্ত হওয়া ঠিক হবে না। কারণ, দেশটির বেসামরিক সরকার কার্যত দন্তহীন বাঘ। তাকে চালায় সামরিক প্রতিষ্ঠান। এই সামরিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে ঘৃণ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সহিংসতা ছড়ানো ছোট–বড় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে এই সংস্থাটি সব সময়ই সহায়তা দেয়। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি জেনারেলদের হাতে, সেহেতু তাঁরাও বেপরোয়াভাবে তাঁদের তৎপরতা চালিয়ে যান।
এ ছাড়া পাকিস্তান হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘নন-ন্যাটো অ্যালায়েন্স’। পাকিস্তান ন্যাটোভুক্ত না হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই দেশটিকে ভারতের মতো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুবিধা পেয়ে থাকে। আফগান তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ককে পাকিস্তানি জেনারেলরা সরাসরি মদদ দিয়ে থাকেন। এই তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার জন্যও এ মুহূর্তে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার।
সব মিলিয়ে এটি পরিষ্কার, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ককে ছিন্ন করতে না পারলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে কোনো দিনই জেতা সম্ভব হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক