সঞ্চয়পত্র কেনা কতটা লাভজনক
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম। অন্যদিকে সরকার ব্যাংক খাত থেকে বর্তমান বাজেটে যে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তার প্রায় পুরোটা এই সময়ের মধ্যেই নিয়ে গেছে।
এত দিন সরকারের সমালোচনা হতো, ব্যাংক আমানতকারীদের যে সুদ দেয়, তার থেকে অনেক বেশি সুদ সঞ্চয়পত্রে দেওয়া হয়ে থাকে। তাই বিনিয়োগকারীরা উচ্চ সুদের আশায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। আর যেহেতু সুদের হার বেশি, তাই প্রতিবছরই বাজেটের একটি বিশাল অংশ সুদের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। এখন কয়েক মাস ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার নিশ্চয় স্বস্তিতে আছে।
এখন সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়ায় আবার সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তাহলে এখন সরকার কী করবে? আসলে সবকিছুতেই একটি ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের নাজুক অবস্থার কারণে সঞ্চয়কারীদের ব্যাংকের ওপর থেকে আস্থা কমে গেছে। প্রতিনিয়তই খবর বেরিয়েছে ব্যাংক তাদের আমানতকারীর টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না।
সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি আরেকটি বিনিয়োগ খাত হলো দেশের শেয়ারবাজার। ২০১০ সালের পর থেকে শেয়ারবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। গত ৯ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজার সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। শেয়ারবাজার কবে ঘুরে দাঁড়াবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। অতএব সেখানেও বিনিয়োগকারীদের আশার আলো নেই।
এত সব নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে এখন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রই সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কয়েকটি কারণে আকর্ষণীয়। তুলনামূলক সুদের হার বেশি। বিনিয়োগ ও সুদ উভয়ই নিরাপদ। নিম্ন হারে কর প্রদান। আর যাঁরা আয়কর প্রদান করেন, তাঁরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে তার ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে কর রেয়াত উপভোগ করেন। এত সুবিধা থাকার পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেল কেন?
এর উত্তরে কয়েকটি কারণের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন টিআইএন বাধ্যতামূলক করা, অনলাইনে বিক্রি শুরু করা এবং ৫০ হাজার টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে চেকের মাধ্যমে কেনার নিয়ম চালু করা ইত্যাদি।
শেষে যে দুইি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন ঝামেলায় পড়তে হবে না। কারণ, অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে তাঁরা যদি অনলাইনে দক্ষ না হন, তাহলে ক্রেতাদের সেবা দিতে আগ্রহী না–ও হতে পারেন। আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইন ব্যবস্থা না–ও থাকতে পারে। সেসব এলাকার বিনিয়োগকারীরা অসুবিধায় পড়বেন। বিশেষ করে যাঁরা পোস্ট অফিস থেকে এত দিন সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, তাঁরা বেশি সমস্যায় পড়বেন।
আর বিনিয়োগকারীরা যদি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে নেন, তাহলে তাঁরা একদিকে যেমন চেক পেয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁরা সুদ পেতে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পাবেন। কারণ, নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাঁদের ব্যাংক হিসাবে সুদ জমা হয়ে যাবে। যাঁরা এত দিন পোস্ট অফিস থেকে কিনতেন, তাঁদের ব্যাংক হিসাবের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এখন ব্যাংক চেকের কারণে সেই সুবিধা আর থাকছে না। বাধ্য হয়েই তাঁদের চেকের জন্য ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে।
টিআইএন বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগকারীদের কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। অনেকেরই ধারণা, টিআইএন নিলে আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হবে এবং তা নিয়ে ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, এই ভেবে তাঁরা ভয়ে থাকেন।
টিআইএন নিলেও এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আয়কর আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিআইএন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, কিন্তু আয়কর বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
এক লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি, ভবন, ফ্ল্যাট হস্তান্তরেও ক্রেতা ও বিক্রেতার ক্ষেত্রে এ বছর থেকে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাঁর টিআইএন নেওয়া হয়েছে কোনো সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য কিন্তু তাঁর করযোগ্য আয় নেই, তাঁর জন্য আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
সঞ্চয়পত্র কিনতে গিয়ে যাঁরা টিআইএন নেবেন, তাঁদের যদি করযোগ্য আয় না থাকে, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। তাঁকে আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হবে না। উল্লেখ্য, পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে করযোগ্য আয় আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত এবং নারী করদাতার ক্ষেত্রে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। অর্থাৎ, তাঁদের আয়কর বিবরণী জমা দিতে হবে না এবং কোনো করও দিতে হবে না।
তবে এ বছর গত বছরের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে আয়কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এ কথা ঠিক। তবে ব্যাংকগুলোর স্থায়ী আমানতের সুদের ওপরও কিন্তু উৎসে করের হার ১০ শতাংশ এবং এ হার যাঁদের টিআইএন নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রে সুদের ওপর যে কর কর্তন করা হয়, তার একটি বড় সুবিধা হলো, তা চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচ্য হয়। অর্থাৎ উৎসে যা কর্তন করা হয়েছে, সেটাই চূড়ান্ত করদায়। বছর শেষে আয় যা–ই হোক না কেন, আর কর দিতে হবে না। বিপরীতে যাঁদের আয় করযোগ্য সীমার নিচে, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে উৎসে যে কর কর্তন করা হয়েছে, তা আর ফেরত দেওয়া হবে না এবং পরের বছর যদি করযোগ্য আয় থাকেও, তাহলে তার সঙ্গেও সমন্বয় করা যাবে না। এটাই হলো অসুবিধা।
তাই সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর কর বাড়ার কারণে যাঁদের আয় শুধু এর ওপরই নির্ভরশীল, তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঘরের গৃহিণী ও অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের ভরসার আশ্রয়স্থল হলো সঞ্চয়পত্র। একজন গৃহিণী যদি মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ পান, তাহলে এখন ব্যাংক ১ হাজার টাকা কেটে ৯ হাজার টাকা তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করবে। আগে ৫০০ টাকা কেটে ৯ হাজার ৫০০ টাকা প্রদান করা হতো। এখন তিনি বছরে ৬ হাজার টাকা কম পাবেন।
জসীম উদ্দিন রাসেল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট