গোলাম মোহাম্মদ কাদেররাজা দ্বারা শাসিত পদ্ধতিকে বলা হয় রাজতন্ত্র। এক ব্যক্তি দ্বারা শাসিত পদ্ধতিকে বলা হয় একনায়কতন্ত্র। জনগণের দ্বারা শাসিত পদ্ধতিকে বলা হয় গণতন্ত্র। দেশের জনগণ সবাই মিলে দেশ শাসন, বাস্তবসম্মত নয়। সে জন্য জনগণকে শাসন করার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয়। সে কারণে গণতন্ত্রচর্চার প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্বাচন। নির্বাচনকে গণতন্ত্রের প্রবেশদ্বার হিসেবে গণ্য করা হয়।
সংবিধানের নির্বাচনসংক্রান্ত সপ্তম ভাগে অনুচ্ছেদ ১১৮ (১) ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ্য ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের বাছাই করার উদ্দেশ্যে ওপরে উল্লেখিত আইনটি প্রণয়নের বিধান করা হয়েছিল। অদ্যাবধি এ-সংক্রান্ত কোনো আইন তৈরি করা হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী (৪৮ অনুচ্ছেদের কারণে) নিয়োগদান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সহায়তাসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ১২৬। এতে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ উল্লেখিত বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকরভাবে দৃশ্যমান নয়।
গণতন্ত্রচর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের কাছে প্রতিনিধিদের জবাবদিহি। কেননা, জনগণ দেশ পরিচালনার প্রকৃত মালিক। তাঁরা প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেন তাঁদের হয়ে দেশ পরিচালনার উদ্দেশ্যে। মালিকের অর্থাৎ জনগণের কাছে তাঁদের প্রতিনিধিদের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও সার্বক্ষণিক জবাবদিহি নিশ্চিত করাকেই বলা যায় গণতন্ত্রের চর্চা। সংবিধানের প্রথমেই বলা আছে, সংবিধানের মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে গণতন্ত্র। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও বলা আছে এখানে। এ বিষয়গুলো বলা থাকলেও সাংবিধানিকভাবে আমাদের গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ নেই।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে দলের বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সংসদে সরকারপ্রধানের বাইরে গেলে ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি দলের সদস্যদের সাংসদ পদ চলে যায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বিজয়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান (যিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী) তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সব প্রস্তাব পাস অথবা বাতিল করতে পারবেন।
গণতন্ত্র মানে জনগণের তন্ত্র। একনায়কতন্ত্র মানে একজনের তন্ত্র। আমাদের সংবিধানে একনায়কতন্ত্রকে সাংবিধানিকভাবে তৈরি করা হয়েছে। যে দল অধিক আসনে বিজয়ী হবে, স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সে দল ক্ষমতায় যাবে। আবার যে দল ক্ষমতায় যাবে, সে দলের প্রধান সাধারণত দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদে সংসদ নেতা, সরকারদলীয় সংসদীয় দলের নেতা হন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে দলের বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সংসদে সরকারপ্রধানের বাইরে গেলে ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি দলের সদস্যদের সাংসদ পদ চলে যায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বিজয়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান (যিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী) তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সব প্রস্তাব পাস অথবা বাতিল করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে যখন কোনো সরকারদলীয় সাংসদ যেতে পারছেন না, তখন সম্পূর্ণ সংসদ তাঁর ইচ্ছেমতো চলবে, এটাই বাস্তবতা।
নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা বা পার্লামেন্ট এবং বিচার বিভাগ—এ তিনটি হলো একটি রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। এ তিন স্তম্ভ পরস্পরের জবাবদিহি নিশ্চিত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান যিনি, নির্বাহী বিভাগের সর্বময় কর্তা তিনিই, একই সঙ্গে আইনসভা বা পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রক। ফলে নির্বাহী প্রধান যা বলবেন, তার বাইরে পার্লামেন্টে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আমাদের সংবিধানে নেই।
আর থাকে বিচার বিভাগ। আমাদের দেশের বিচার বিভাগের নিম্ন আদালতগুলো চলবে ঊর্ধ্বতন আদালতের নির্দেশে (সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে)। নিম্ন আদালতে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের বেতন-ভাতাদি, চাকরি এবং চাকরির পদোন্নতি, বদলি সবকিছু করবেন রাষ্ট্রপতি (সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বিষয়টি উল্লেখ আছে)। অর্থাৎ এখানে ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সাংঘর্ষিক এবং বাস্তবে ১১৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর। আবার ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বর্ণিত ২২ অনুচ্ছেদ ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’— এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষমতা একটি সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে নেওয়া হয়েছিল। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সংসদে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অধীন নেওয়া।
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি শুধু দুটো কাজ, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগদান ছাড়া বাকি সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ (অবশ্যপালনীয়) মোতাবেক করতে হবে। এর মানে, রাষ্ট্রপতি যে কাজগুলো করছেন, সেগুলো করছেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক। এককথায় নিম্ন আদালত রাষ্ট্রপতির নির্দেশে চলা মানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চলা। অর্থাৎ নিম্ন আদালত প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন।
উচ্চ আদালতের ব্যাপারে সংবিধানের ৯৫ এ বলা আছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’ এখানে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ অবশ্যপালনীয় নয়। ৯৫(২)-এ বর্ণিত আছে, বিচারপতি হওয়ার জন্য প্রার্থীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। আরও বলা হয়েছে, ‘ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া; অথবা খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে; অথবা গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
বাস্তবতা হচ্ছে (গ)-এ বর্ণিত আইনটি এখন পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। আবার সংবিধানের ৪৮ ধারার কারণে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া ওই কাজটি করতে পারবেন না। ফলে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ করছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক করতে হচ্ছে। অর্থাৎ বাস্তবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ করতে পারছেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ইচ্ছামাফিক, শুধু ওপরের (ক) ও (খ) মেনে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষমতা একটি সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে নেওয়া হয়েছিল। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সংসদে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অধীন নেওয়া।
উচ্চ আদালতের এক রায়ে সংসদের ওই সিদ্ধান্তকে বাতিল করা হয়েছে। যার জন্য উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের বরখাস্তটি প্রধানমন্ত্রী করতে পারছেন না। কিন্তু নিয়োগ দিতে পারছেন। তার মানে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা সম্পূর্ণভাবে এবং বিচার বিভাগ এর প্রায় ৯৫ শতাংশ এখন শুধু এক ব্যক্তির হাতে। অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সার্বিক বিচারে বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে চলমান ব্যবস্থাকে একনায়কতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে আমরা শাসনব্যবস্থাকে একনায়কতন্ত্র করেছি। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা নেই ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রচর্চার কোনো সুযোগ নেই, বললে অত্যুক্তি হয় না।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের সাবেক মন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের উপনেতা