খবর জানার আগ্রহ মানুষের অন্যতম আদিম প্রবৃত্তি। বছরের পর বছর জেলেরা নদীতে মাছ ধরেন। তা কোনো খবর নয়। একদিন শোনা গেল ঝোড়ো হাওয়ায় নৌকাডুবিতে কয়েকজন মৎস্যজীবী ও মাঝি মারা গেছেন। সেটি একটি সংবাদ বা দুঃসংবাদ। দশ গ্রামের মানুষের তা জানার আগ্রহ। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, কতজন মারা গেলেন, কী তাঁদের পরিচয়, প্রভৃতি নানা প্রশ্ন মানুষের মনে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে সেসব প্রশ্নের উত্তর থাকে।
যে বস্তুর নাম সংবাদপত্র, তা কী জিনিস, তা তার নামই বলে দেয়। কিন্তু আধুনিক সংবাদপত্র ঘটিত বা সংঘটিত বিষয়ের বিবরণই শুধু পরিবেশন করে না, তার ভূমিকা বিশাল ও বিচিত্র। জীবন ও জগতের সবকিছুই তার উপজীব্য। আধুনিক জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু সংবাদপত্র। জীবনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো গুরুতর বিষয়ের দার্শনিক ভিত্তি যদি শক্ত না হয় তাহলে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ হয় না। সংবাদপত্রের দর্শন রয়েছে এবং রয়েছে সাংবাদিকতার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি।
হাজার হাজার বছর পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎ কী জিনিস, তা মানুষ জানত না। কিন্তু তাতে সভ্যতার অগ্রযাত্রা নেমে থাকেনি। কিন্তু এখন যদি বিশ্বব্যাপী কোনো একটি দিন বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে, তাহলে মানুষের যে ক্ষতি হবে, তা বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগের ১০০ বছরেও হয়নি। ছাপা সংবাদপত্রের বয়স চার শ বছর। তার আগে সংবাদপত্র ছিল না। তখনো পৃথিবী যথানিয়মে চলেছে। কিন্তু আজ যদি সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম মাত্র একটি দিন বন্ধ থাকে, তাহলে মানবসমাজের কী অবস্থা হবে, তা কল্পনা করা সম্ভব।
কি পশ্চিম ইউরোপে, কি ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের উদ্ভব ও বিকাশ সপ্তদশ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে, সামন্তবাদী সমাজে। সমাজের একটি বড় অংশ বিদ্যমান অবস্থা মেনে নিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। কিন্তু সমাজের প্রগতিকামী অংশ অর্থাৎ অগ্রসর অংশ বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। আর্থসামাজিক অবস্থা যেমনটি আছে তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। সেই বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সংবাদপত্রের ভূমিকা বিরাট। শুধু সংবাদ পরিবেশন সংবাদপত্রের এখন আংশিক কাজ। তার বাইরেই তার কাজের বিস্তৃতি বেশি। নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণই বেশি।
কায়েমি স্বার্থকে আঘাত করা সংবাদপত্রের এখন একটি বড় দায়িত্ব। কায়েমি স্বার্থ সংঘবদ্ধ, কিন্তু সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে লড়তে হয় একা। তাঁর নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গী না থাকলেও তাঁর সমর্থক অগণিত। সেটাই সংবাদপত্রের শক্তি। যে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের নৈতিক অবস্থান বা দার্শনিক ভিত্তি শক্ত, জনকল্যাণে সেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ঔপনিবেশিক সময়ে সংবাদপত্রকে লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার জন্য বা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। সামন্তবাদী সমাজে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজে তাহলে কি সংবাদপত্রের কাজ কমে গেছে? তা নয়; বরং বেড়েছে। একটি সমাজ গঠনে সংবাদপত্রকে এখন বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির মানবিক অধিকার এখন কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একদিকে সর্বশক্তির অধিকারী রাষ্ট্র, আরেক দিকে একজন সহায়সম্বলহীন দুর্বল মানুষ। সেই দুর্বলের অধিকার যখন রাষ্ট্র হরণ করে, তাঁর পাশে দাঁড়ায় সংবাদপত্র। সংবাদপত্রকে লড়াই করতে হয় সবচেয়ে শক্তিধরের সঙ্গে। সাংবাদিকের কী সেই অস্ত্র আছে, যার দ্বারা তিনি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে মোকাবিলা করেন? তা তাঁর নৈতিক অবস্থান।
নন্দিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রকে প্রশংসা করে বহুবার বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র রয়েছে, সেখানে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় কম। যেখানে গণতন্ত্র নেই এবং স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, সেখানে অনাহারে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন ভারত ও চীনের। স্বাধীন ভারতের কোথাও যখনই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে তা নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় সরকার অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। তাতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং প্রাণহানি ঘটেছে কম। চীনের বহু অঞ্চলে একসময় দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে, স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকায় সেই মৃত্যুর কথা বাইরের মানুষ জানতে পারেনি। সরকার ব্যবস্থা নেয়নি।
যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই, স্বাধীন সংবাদপত্র নেই অথবা থাকলেও তা সরকারেরই মুখপত্র, জনগণের মুখপত্র নয়, সেসব দেশের মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার এবং তার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে যখন রামুর বৌদ্ধপল্লিতে আক্রমণ হলো, ভস্মীভূত করা হলো তাদের ঘরবাড়ি, বিহার, তখনকার সেখানকার বাস্তব অবস্থা আমাদের সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশন করে। তার ফলে আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সেখানে দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে যাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যান। তিনি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাড়িঘর সেনাবাহিনীকে দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে নির্মাণ করিয়ে দেন। কয়েক মাস পরে বোঝা যায়নি যে সেখানে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। সে জন্য সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল খুব বড়।
সব সমাজেই বিবেকসম্পন্ন নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন। মিয়ানমারের বার্মিজদের মধ্যেও নিশ্চয়ই আছেন। সামরিক স্বৈরাচার ও সু চির অপকর্ম তাঁরা সমর্থন করবেন না। মিয়ানমারে সে রকম কোনো সংবাদপত্র থাকলে, তাতে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর সরকারি পাশবিকতার ঘটনা যদি প্রকাশিত হতো তাহলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটত না। মিয়ানমারে সামান্য কিছু সংবাদপত্র যা আছে তার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। সেগুলো সরকারের মিথ্যাচার প্রচারের যন্ত্রমাত্র। সেগুলো সংবাদপত্র পদবাচ্য নয়।
জঘন্য মিথ্যাচারের একটি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মিয়ানমারের একটি সংবাদপত্র ও তার সাংবাদিকেরা। খবরটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার ষড়যন্ত্র করেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। মিয়ানমারের কাগজে কাজ করা একজন ভারতীয় সাংবাদিক খবরটির স্রষ্টা। প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রান্তের বিষয়টি ভারত সরকার ‘সময় নষ্ট না করে’ বাংলাদেশকে সতর্ক করে দেয়। ভারতের একটি প্রধান দৈনিকেও ওরকম একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। খবরটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অসামান্য উদ্বেগ সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গা সংকট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে ওই প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।
সংবাদটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সংবাদটি ছিল ‘স্পেকুলেটিভ’, জল্পনামূলক। বাস্তবিকভাবে ওটি ছিল নৈতিকতাবর্জিত ও উদ্দেশ্যমূলক। ভারতের কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই খবরকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না, সমর্থনও করছে না।’ [প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর] সাংবাদিকের নৈতিক আদর্শ না থাকলে এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে শঠতা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতা থাকলে সাংবাদিকতার নামে এ-জাতীয় অপতৎপরতা হতে পারে। সংবাদপত্রকে থাকতে হয় সত্যের পক্ষে, সেটাই তার দার্শনিক ভিত্তি।
সংবাদপত্র এককভাবে সমাজকে বদলাতে পারে না। তা যদি পারত তাহলে সরকার ও সংস্কারকদের প্রয়োজন হতো না। যার যা কাজ, সে তা-ই করবে। সরকারের কাজ সরকার করবে। সমাজের অগ্রগতির লক্ষ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান যাঁরা, তাঁরা তাঁদের কাজ করবেন। তাঁদের সহযোগী শক্তি হিসেবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কাজ করে সংবাদপত্র।
বাংলাদেশে এখন অনেকগুলো উন্নতমানের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থা ইন্টারনেটের কল্যাণে জোরদার হওয়ায় সংবাদপত্রের সামনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। কোনো কারণে মূলধারার সংবাদপত্র কোনো সংবাদ আড়াল করতে চাইলেও এখন আর তা সম্ভব নয়। পত্রিকার এখন প্রধান কাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে অবিচল থাকা। মানুষের চেতনার মান উন্নত ও শাণিত করাও সংবাদপত্রের অন্যতম দায়িত্ব।
উনিশ বছর বয়সী প্রথম আলো একটি সংবাদপত্র শুধু নয়। উনিশ বছর যাবৎ এই পত্রিকার একজন পাঠক ও লেখক হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ, বিবর্তন ও বিকাশের ধারা লক্ষ করে যে ধারণা হয়েছে তাতে বলা যায়, প্রথম আলো একটি দৈনিক পত্রিকা মাত্র নয়, প্রথম আলো যুগপৎ একটি সংবাদপত্র ও একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের কাজ মিশনের মতো।
সমালোচকদের চোখে প্রথম আলোর সীমাবদ্ধতা ধরা পড়তে পারে। তা অস্বাভাবিক নয়। একটি প্রতিষ্ঠান সমাজের সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি পূরণ করতে পারে না। তা সম্ভব নয়। বিবেচনা করতে হবে তা জাতির সার্বিক চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে কতটা। যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে, তা তত সার্থক। প্রথম আলো যে সমাজের চেতনাকে ধারণ করতে পারছে, তার প্রমাণ তার ক্রমবর্ধমান পাঠকসংখ্যা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে পঠিত হচ্ছে প্রথম আলো। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা, তার সম্পাদকীয় দপ্তর, সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অভিনন্দন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।