এই লেখা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। মা দুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা যাঁর যঁার ঘরে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশে এবারের দুর্গোৎসব তঁাদের মনে যে ক্ষত রেখে গেল, তা সহজে মুছে যাবে না।
প্রতিবছর দুর্গোৎসব সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা সরকারের কাছে পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানিয়ে থাকেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন বুধবার কুমিল্লার অঘটনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুর ও মন্দিরে হামলার যেসব ঘটনা ঘটল, তা কেবল উৎসবকে ম্লান করেনি; মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকেও লজ্জায় ফেলেছে।
গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে কথা হয় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীউল হকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, শুক্রবার কুমিল্লায় কোনো অঘটন ঘটেনি। সারা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন ছিলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণসংহতির আহ্বায়ক জুনায়েদ সাকি এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা সুব্রত চৌধুরী ও নিম চন্দ্র ভৌমিক কুমিল্লা গেছেন এবং নানুয়া দীঘিরপাড় পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে তাঁরা আলাদাভাবে কথাও বলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সুব্রত চৌধুরীর বক্তব্যেও একই সুর ছিল। নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আছে, তেমনি আছে সাম্প্রদায়িকতাও।
বাংলাদেশকে আমরা সম্প্রীতির দেশ বলে দাবি করি। কিন্তু সম্প্রীতির দেশে একটি সম্প্রদায়ের উৎসব উদ্যাপন করতে কেন এত পুলিশি নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে? সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উৎসব সামনে রেখে তো নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন আসে না। প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একবার খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রটি ছিল সাম্প্রদায়িক, কিন্তু সমাজটি ছিল অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশ আমলে রাষ্ট্র ও সমাজ—দুটিই সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে। সামরিক শাসক এরশাদের রাষ্ট্রধর্মের প্রেক্ষাপটে তিনি কথাটি বললেও, এখনো আমরা সেই অবস্থা থেকে খুব বেশি এগোতে পারিনি। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম দুটোই বহাল আছে।
সরকারি দলের নেতারা নিয়ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তোলেন। কিন্তু তাঁদের এই অসাম্প্রদায়িক শাসনামলে কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বারবার সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। মাওলানা ভাসানী বলতেন, নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না। সাম্প্রদায়িকতাও তেমনি। মুখে দাবি করলেই কেউ অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। কাজে এর প্রমাণ দিতে হয়। কুমিল্লার সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিলে নানুয়াদীঘির পাড়ের মণ্ডপের ঘটনাটি এত দূর গড়াত না। ওই পূজামণ্ডপে কে বা কারা পবিত্র কোরআনের কপি রেখে গেছে, সেটি কি কখনো জানা যাবে? হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ কেন সেখানে কোরআন নিয়ে যাবেন? আবার কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানও এ কাজ করবে না। তাহলে কি কোনো দুষ্টচক্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই এ কাজ করেছে?
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘািত হামলা ও সহিংসতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা এখনো ফাইলবন্দী আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেসব মামলারও বিচার হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পায়নি।
ঘটনার পরপরই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রশাসনের কাছে দ্রুত পূজামণ্ডপগুলোতে পুলিশ পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ গেছে অনেক পরে। অনেক পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। এটা বিচলিত হওয়ার খবরই বটে। এরপর আমরা দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও আক্রমণ করার ঘটনা ঘটল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ১০টি জেলায় ২২টি মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। ২২টি জেলায় পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
কুমিল্লার ঘটনায় এ জেলায় গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। কুমিল্লার ঘটনার জেরে প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। সেখানে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে একদল লোক মিছিল বের করে। তারা একাধিক মন্দিরে হামলা চালাতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায় এবং এতে ৪ জন নিহত, পুলিশসহ ৫০ জন আহত হন। তৌহিদী জনতার ব্যানারে এ মিছিল বের করা হলেও যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের একজন কলা বিক্রেতা ও তিনজনের বয়সই ২০ বছরের কম। তাঁরা কি স্বেচ্ছায় মিছিলে গিয়েছিলেন, না তাঁদের প্ররোচিত করা হয়েছিল? এই যে তিনটি শ্রমজীবী পরিবারের তিন সন্তান মারা গেলেন, তঁাদের পরিবার কীভাবে চলবে? হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
দেশের আরও অনেক স্থানের মতো কুমিল্লাও পরিচিত ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর হিসেবে। এই শহরই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মভূমি, এই শহর শচীন দেববর্মনের জন্মভূমি। শচীন দেব যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, সেখানে শচীন দেববর্মন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯২২ সালে এ শহরেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাঁধে হারমোনিয়াম নিয়ে গেয়েছিলেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!/ ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,/ সন্তান দ্বারে উপবাসী,/ দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!’ আজ সেই শহরে মানবতার লাঞ্ছনা আমরা কী করে মেনে নিই?
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, মন্ত্রিপরিষদের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লার ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। যাঁরাই এটি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা ধর্মকর্ম করেন, যাঁরা ধর্মকর্মে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেন না। এটি দেশের সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন বিনষ্ট করার জন্যই একটি প্রক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টের চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। যারা এ ধরনের চেষ্টা করছে কিংবা অব্যাহত রাখবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের কাজ তো শুধু ঘটনার পেছনে পেছনে ছোটা নয়। সরকারের নানা গোয়েন্দা বাহিনী আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা আগাম ব্যবস্থা নিল না কেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে পূজামণ্ডপে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে কেউ সাহস না পায়। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা কতটা আশ্বস্ত করবে, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎ–ই দিতে পারবে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা হলো সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সরকারের আমলে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, সহিংস ঘটনা ঘটেছে, খু্ব কম ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘািত হামলা ও সহিংসতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা এখনো ফাইলবন্দী আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেসব মামলারও বিচার হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পায়নি। বরং নাসিরনগরের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় দুই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগ ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিল; বিভিন্ন সমালোচনার মুখে সেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হলেও বিচারের বাণী এখনো নীরবেই কাঁদছে।
যে দেশে হামলা-সহিংসতার বিচার হয় না, সে দেশে সংখ্যালঘুরা নিজেদের কখনো নিরাপদ ভাবতে পারেন না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি