একটি সময় ছিল, যখন মক্তব বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও নিজেদের মধ্যে মারামারি করা গর্হিত কাজ মনে করতেন। আজ এই বাংলার মাটিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও অনেকেরই মারামারিতে অরুচি নেই।
মারামারিরও প্রকারভেদ রয়েছে। হাতাহাতি বা জামার কলার ধরে টানাটানি করা তেমন গুরুতর নয়। তা ছাড়া হালকা মারামারির মধ্যে চপেটাঘাত বা থাপ্পড়; তার চেয়ে আর খানিকটা বেদনাদায়ক ঘুষাঘুষি এবং গুরুতরই শুধু নয়, অপমানকর হলো পদাঘাত বা লাথি। কারও লাথি খেয়ে কেউ যদি মেঝেতে পড়ে যায়, তাতে শারীরিক ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা হাজার গুণ বেশি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিলে বা মালিশ-টালিশ করলে ব্যথা কমে যায়, কিন্তু অন্তরের আঘাত থেকে যায় অনির্দিষ্টকাল।
সেদিন সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একই গোত্রের শিক্ষকদের মধ্যে বেশ এক প্রস্ত মারামারি হয়ে গেল। তাতে আহত হয়েছেন কেউ কেউ। যঁারা আহত হয়েছেন, তঁারা যথেষ্টই দৈহিক ও মানসিক আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু সেই মারামারির খবর যখন মিডিয়ার কল্যাণে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন যঁাদের সন্তানেরা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন, তঁারা লজ্জায় মাথা নিচু করেছেন। তঁারা ভেবেছেন, বিদ্যা অর্জনের জন্য কাদের কাছে তঁারা সন্তানদের পাঠিয়েছেন।
যখন কোনো শ্রেণির মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে, তা হালকা থেকে মাঝারি যা-ই হোক, তাকে তাদের রোগ মনে করার কারণ নেই। তা উপসর্গ মাত্র। রোগ অনেক গভীরে। সেই রোগের কারণ প্রভৃতি অনুসন্ধান করে তা দূর করার ব্যবস্থা না করলে উপসর্গ নিয়ে হাহাকার করে কোনো লাভ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে মৃদু অথবা প্রচ্ছন্ন রেষারেষি আগেও অল্পস্বল্প ছিল, কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ ঘটতে পারেনি। এখন শিক্ষকদের দলীয় ফোরামেও মারামারি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। দলীয় রাজনীতির নোংরামি শিক্ষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। টিএসসিতে সর্বশেষ মারামারির ঘটনার পর পত্রপত্রিকায় শিক্ষকরাজনীতি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। ‘প্রধান ছয়টি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই অধিকাংশ শিক্ষক রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। এগুলো হচ্ছে প্রবেশপদে নিয়োগ, পদোন্নতি, বাসা বরাদ্দ, নিজের অথবা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেওয়া।’ [যুগান্তর, ৫ নভেম্বর]
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বরাত দিয়ে ‘ছয়টি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের’ কথা বলা হলেও দলাদলি ষড়্স্বার্থেই সীমাবদ্ধ নয়, স্বার্থের তালিকা আরও দীর্ঘ। বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান অথবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যের পদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই তৈরি থাকে। যঁার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো কিছুই পাওয়ার নেই, তিনি ঠিকমতো ক্লাস না নিয়ে, গবেষণা না করে, নিজের পারিবারিক ও বৈষয়িক কাজে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধাটা নিয়ে নেন দলীয় রাজনীতির ছাড়পত্র নিয়ে। চাকরিটি তঁার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের, সারা দিন ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিতে। সেখানে অবশ্য কাজে ফঁাকি না দিয়ে বেতনের টাকা কড়ায়-গন্ডায় উশুল করিয়ে দিয়ে আসছেন।
সবাই স্যার পি জে হার্টগ বা স্যার এ এফ রহমানের মতো উপাচার্য হবেন, তা কেউ আশা করে না। কিন্তু যঁারাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হোন, তঁাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠবে কেন? মোটা বেতনের চাকরি করছেন, তারপর আরও টাকার কী প্রয়োজন? ত্রিশাল উপজেলার এক যুবকের অভিযোগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টাররোলে চাকরি পেতে আট লাখ টাকা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে। ‘এই টাকার জোগান দিতে নিজের মূল্যবান দুই কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়েছে তঁাকে। চাকরি পেতে একইভাবে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে টাকা দিয়েছেন তঁার গ্রামের আরও কয়েক যুবক। ত্রিশালের আরেক যুবক বলেন, চাকরি না পেয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের কাছে টাকা ফেরত চাইলেও এখনো ফেরত পাননি। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, ২০১৪ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর [উপাচার্য] নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে আরও সাত-আটজন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন।...বেপরোয়া বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন কমপক্ষে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।’ [সমকাল, ৫ নভেম্বর]
ঘুষঘাষ দিয়ে যঁারা চাকরি পান, তঁাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে এবং তঁাদের নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তঁারা তঁাদের হাত ও পা এস্তেমাল করতেই পারেন। দলীয় শিক্ষকদের সভায় ‘চেয়ার থেকে উঠে এসে [সহকর্মীর] বুকের বঁা দিকে দুই হাত দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত’ করা, ‘ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া’, ‘বেষ্টনী ভেঙে লাথি মারতে উদ্যত’ হওয়া বা ‘একপর্যায়ে চেয়ার নিয়ে মারতে’ যাওয়া তঁাদের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাই যে শোচনীয় তা নয়; বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপারিশ করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ আজ সয়লাব। ২০১৬ সালে ৮৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫টিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মহামান্য আচার্য রাষ্ট্রপতিরও কিছু করার নেই। কোথায় পাবেন তিনি অতগুলো যোগ্য ব্যক্তি, যঁাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া যায়? দালানকোঠা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। শিক্ষকেরা কী শিক্ষাটা দিচ্ছেন, সেটাই মুখ্য। বিশ্বভারতীতে বহু দিন উঁচু ইমারত ছিল না। গাছতলায় হয়েছে ক্লাস। প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, দেশ ভরে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বেশুমার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটায় জাতির ক্ষতি হচ্ছে দুইভাবে। তঁারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়ায় সেখানে শিক্ষাদানে ব্যাঘাত ঘটছে। তঁারা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোযোগ দিতে পারেন না। তাতে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। যথেষ্টসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক না থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যঁারা বেরিয়ে আসছেন, তঁারাও পাচ্ছেন না উপযুক্ত শিক্ষা। ফলে জাতি একদিন মেধাহীন অযোগ্য মানুষের সমাবেশে পরিণত হবে। কয়েক দিন আগে আমার পুরোনো পরিচিত এক ব্যক্তি দেখা করতে এসেছিলেন, এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আগে তিনি একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম বন্ধ ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ইউজিসির প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ আছে। তার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২০ বছরের শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপকদের পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু এ দেশের কার সুপারিশ কে শোনে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ আদালতের নির্দেশ মানারই পরোয়া করে না।
রাষ্ট্রের সামগ্রিক অবস্থার বাইরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠন নয়। সব জায়গায় অসত্য ও দুর্নীতি অপ্রতিহতভাবে চলবে আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোকেরা হবেন যুধিষ্ঠির, তা হতে পারে না। তা সত্ত্বেও মানুষ মনে করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন একটি কারখানা, সেখানে যে জিনিস তৈরি হয়, তঁারাই জাতির প্রধান সম্পদ। একদিন তঁারা রাষ্ট্র চালাবেন, প্রশাসন চালাবেন, ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবেন, উন্নত সংস্কৃতি সৃষ্টি করবেন, বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন, সমাজসেবা করবেন। সেই কারখানার যঁারা কারিগর, একটু কষ্ট করে হলেও, তঁারা দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন। বিশেষ করে ঘরের ভেতরে নিজেরা নিজেরা যা–ই করুন, প্রকাশ্যে এমন আচরণ করবেন না, যা তঁাদের প্রতি মানুষকে করে শ্রদ্ধাহীন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।