শিরানি বন্দরনায়েক সারা বিশ্বেই সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন নানা কারণে। তিনি শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তখনকার প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে নানা রায় দিয়ে তিনি তাঁর রোষানলে পড়েন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাঁকে অপসারণ করা হয় ২০১৩ সালে। পরে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ দেশি-বিদেশি নানা তদন্তে প্রমাণিত হয়, তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল অন্যায়ভাবে। নতুন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার আমলে অপসারণ খারিজ করে তাঁকে প্রধান বিচারপতি পদে বসানো হয় ২০১৫ সালে। দুর্নীতির কালিমামুক্ত হয়ে মাত্র এক দিন দায়িত্ব পালন করে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
শিরানির মতো প্রধান বিচারপতির সর্বোচ্চ পদে আসীন একজনকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছিল কীভাবে? তার সহজ উত্তর রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ-সংক্রান্ত শ্রীলঙ্কার সংবিধানের বিধানে। সেখানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদের হাতে। বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতাও ছিল সংসদের হাতে। রাজাপক্ষের অনুগত সাংসদেরা এই সুযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্ব দেন পার্লামেন্টেরই সিলেক্ট কমিটিকে। তদন্তে মারাত্মক অনিয়ম থাকায় তা আদালত স্থগিত করে দেন। সে অবস্থাতেই পার্লামেন্টের ভোটের ভিত্তিতে শিরানিকে অপসারণের প্রস্তাব পাঠানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পদচ্যুত করেন রাজাপক্ষে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানের প্রায় অবিকল বিধানই ছিল বাংলাদেশ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে। এই সংশোধনী অনুসারে পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে ক্ষমতা ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের জন্য প্রস্তাব করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার। অসদাচরণ বা অক্ষমতার অভিযোগে পদচ্যুত করার আগে অভিযোগটি কী পদ্ধতিতে তদন্ত করা হবে, তা আইন দ্বারা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সংসদকেই। এই আইন সাংসদেরা দুই বছরেও করেননি। কিন্তু কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে রুষ্ট হলে তাঁকে অপসারণের জন্য শ্রীলঙ্কার মতোই কোনো পার্লামেন্টারি কমিটিকে তদন্ত করার ক্ষমতা দিয়ে আইন প্রণয়নের সুযোগ তাঁদের ছিল। বিচারপতিদের অপসারণ করার এমন আশঙ্কা জিইয়ে রাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক একটি হুমকি ছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানানোর সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে এটিই।
২.
আমাদের সাংসদেরা অবশ্য ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে খুশি হননি। তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সংসদের কাছে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে সমস্যা কী, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেই তো তা আছে। তাঁদের এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়। ২০১৫ সালে কমনওয়েলথভুক্ত ৪৮টি দেশের ওপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১৬টি দেশের সংসদের হাতে রয়েছে এই ক্ষমতা। বাকি দেশগুলোর মধ্যে ২০টিতে অ্যাডহক (অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গঠিত) ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয় প্রধান বিচারপতি বা জুডিশিয়াল কমিশনের প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে। বাকি দেশগুলোর ১০টিতে স্থায়ী ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলের (যেমন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) তদন্তের ভিত্তিতে বিচারকদের অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে।
যে ১৬টি দেশে পার্লামেন্টের ভোটাভুটির ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করা হয়, সেখানেও ১২টি দেশে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করে বিচার বিভাগ। যেমন ভারতে জাজেস এনকোয়ারি অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুসারে এই তদন্ত করে থাকে তিন সদস্যের একটি কমিটি, যার দুজন সদস্যকে অবশ্যই হতে হয় উচ্চ আদালতের বিচারক। যে মাত্র চারটি দেশের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি, তার দুটি ছিল শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার নতুন সংবিধানের খসড়ায় এ বিষয়ে বড় ধরনের সংশোধনী আনার প্রস্তাব রয়েছে। আর বাংলাদেশে এই বিধান ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে। কাজেই ষোড়শ সংশোধনীর অনুরূপ বিধান এই মুহূর্তে পৃথিবীতে রয়েছে মাত্র দুটি দেশে। দেশ দুটি হচ্ছে সামোয়া ও নাউরু। ৪৮টি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মধ্যে মাত্র এ দুটি দেশেই কেবল উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রে তদন্ত বা বিচার কোনো ক্ষেত্রেই বিচার বিভাগের কোনো সংশ্লিষ্টতার বিধান নেই।
ওপরে বর্ণিত গবেষণাটি ছিল ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড কম্পারেটিভ ল–এর অধীনে বিংহাম সেন্টার ফর দ্য রুল অব ল নামের প্রতিষ্ঠানের। এই গবেষণাপত্রে বহু আইনজ্ঞের সতর্কবাণী আছে ষোড়শ সংশোধনীর মতো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত আরও বহু গবেষণা হয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা। এসব গবেষণা অনুসারে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের জন্য সবচেয়ে খারাপ প্রক্রিয়া হচ্ছে এটি সম্পূর্ণভাবে শাসন বিভাগের হাতে দিয়ে দেওয়া। ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীতে একতরফাভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা প্রদান ছিল এ রকমই একটি নিকৃষ্ট ব্যবস্থা। পরে ১৯৭৭ সালে এটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের যে পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়, তাতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছেই রাখা হয়। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র দুজন বিচারককে নিয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কিত এই রক্ষাকবচকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় বলে ভাবা হয় পরবর্তী সময়েও। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে এই সংশোধনীকে অবৈধ হিসেবে রায় দেওয়ার পরও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি সংবিধানে রেখে দেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ প্রস্তুতির পর পঞ্চদশ সংশোধনী এনে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি রেখে দেয়। সে ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কেন তারা ষোড়শ সংশোধনী এনে বিধানটি বাদ করেছিল, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা কোথাও দেওয়া হয়নি কখনো।
৩.
ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সংশোধনীটি বাতিল হওয়ার কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানসংবলিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আমাদের সাংসদেরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শালীন-অশালীন বহু কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে এই ব্যাখ্যা কোথাও নেই যে দুটি ব্যবস্থার মধ্যে কেন জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি পরিত্যাজ্য। তাঁরা এর সমালোচনা করে বলেছেন, এটি পাকিস্তানি ব্যবস্থা! কিন্তু শুধু পাকিস্তানি ব্যবস্থা হওয়ার কারণেই যদি এটি বাদ দিতে হয়, তাহলে তাঁরা নিজেরাই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে নতুন করে ‘পাকিস্তানি’ বিধান (যেমন সংবিধান লঙ্ঘনের বিচার-সম্পর্কিত ৭ক) অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন কেন? কেন রেখে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের অনুরূপ আরও কিছু বিধান (যেমন রাষ্ট্রধর্ম-সম্পর্কিত ২ক)? আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে তঁারা শুধু ‘পাকিস্তানি’ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে বা অব্যাহত রেখে ক্ষান্ত হননি, সংবিধানের ৭খ-তে এগুলোকে চিরকালের জন্য অপরিবর্তনীয় হিসেবেও ঘোষণা করেছেন!
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হলো কেন? প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বিচারপতিদের অপসারণ-সম্পর্কিত ১৯৭২ সালের সংবিধানটি খোদ আওয়ামী লীগ সরকারই পরিবর্তন করেছিল ১৯৭৪ সালের চতুর্থ সংশোধনীতে। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের আমলে করা আরও কিছু সংশোধনী (যেমন দ্বিতীয় সংশোধনী ও পঞ্চদশ সংশোধনী) ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক ও বিপরীতধর্মী। কাজেই বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার আবেগও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে ক্ষুব্ধ হওয়ার যৌক্তিক কারণ হতে পারে না।
৪.
ষোড়শ সংশোধনীর রায় কার্যকর হওয়ার কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। যাঁরা মনে
করেন এটি হয়নি, তর্কের খাতিরে তা যদি আমরা স্বীকার করে নিই, তাহলে এই মুহূর্তে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রে ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট প্রযোজ্য হবে বলা যায়। তবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে এমন একটি বারোয়ারি আইনের প্রয়োগ কোনোক্রমেই সুবিবেচনাপ্রসূত হবে বলে আমি মনে করি না।
প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই আমাদের রেখে দেওয়া উচিত? আমি তা মনে করি না। আমার মতে বরং ভারতীয় মডেল অনুসরণ করে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা রক্ষার্থে এর বিচারপতিদের অপসারণ-সম্পর্কিত নতুন একটি সংশোধনীর কথা ভাবতে পারি।
নতুন সংশোধনীর মূল বিধানগুলো হতে পারে এরূপ:
ক) গুরুতর অসদাচরণ বা অক্ষমতার অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উদ্যোগে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের প্রস্তাব করবে সংসদই। খ) তবে এই অভিযোগের তদন্ত করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তারা কোনো অভিযোগের সত্যতা পেলেই কেবল এর ওপর পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হবে। দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অপসারণের পক্ষে মত দিলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণ করবেন। গ) এই ভোটাভুটির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ,ÿ ক্ষমতাসীন দল কোনো বিচারককে অপসারণ করতে চাইলেও তার সাংসদেরা দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য থাকবেন না।
নতুন সংশোধনীর প্রস্তাব নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে। তবে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রকৃত জনপ্রতিনিধির সংসদে হওয়াটাই সমীচীন হবে। ষোড়শ সংশোধনীর একটি পূর্ণাঙ্গ রায় আমাদের তত দিনে পেয়ে যাওয়ার কথা। আলোচনাটি হতে হবে সেই রায়ের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।