২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ষোড়শী বা সুইট সিক্সটিন

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ২৫৭ বছরে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান নেতারা একবারই একটি বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছিলেন। মাত্র একবার, দুবার নয়।
শ খানেক বছর আগের কথা। দেশের বিভিন্ন শহরের মতো ঢাকায়ও জজকোর্ট প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা। গিলে করা পাঞ্জাবির পকেটে ধুতির খুঁট গুঁজে হিন্দু সমাজপতিরা উপস্থিত। অনেক দিনের পুরোনো আচকান-পাজামা পরে, হাতে-মুখে মেস্ক আম্বর আতর মেখে উপস্থিত মুসলমান সমাজপতিরা। সরকারের এক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদে বসেছেন। কেবল গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে দুই সম্প্রদায়ের এমন নওল যুবক ও কিশোরেরা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনছে। দুই সম্প্রদায়ের নেতারা সব ভেদাভেদ ভুলে বুকে বুক, কাঁধে কাঁধ ও হাতে হাত রেখে একটি বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। বিষয়টি অতীব জরুরি। তাঁদের সিদ্ধান্তের ওপর বাঙালি পুরুষদের যৌনজীবনের সুখ নির্ভর করছে। রাজনীতি নয়, অর্থনীতি নয়, সমাজনীতি নয়—বাঙালি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হলো যৌন প্রশ্নে।
সেকালে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে প্রায় সব বাঙালি মেয়ের বিয়ে হতো সাত-আট থেকে ১০ বছরের মধ্যে। যেসব পরিবারের অভিভাবকদের কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান ছিল, তাঁরা রজঃবতী না হওয়া পর্যন্ত পুত্রবধূকে শাশুড়ি, দাদিশাশুড়ি বা বিধবা পিসির
কাছে শুতে দিতেন। তবে কাণ্ডজ্ঞান ও বিবেচনাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাঙালি সমাজে চিরকালই বিরল। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বউমাকে ছেলের ঘরে ঠেলে দিত। বাঙালি বালিকা-কিশোরীর আর্তনাদ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছালেও শ্বশুর-শাশুড়ি রাখতেন কানে তুলা গুঁজে।
আলোচ্য ঘটনাটি ঘটে কলকাতার এক গলির মধ্যে। সেটি ছিল ঘনবসতিপূর্ণ। এক হৃষ্টপুষ্ট যুবক বছর আটেকের এক বালিকাকে, বস্তুত শিশুকে, ধুমধাম করে বিয়ে করে আনে। নির্মম অভিভাবকেরা তাকে বাসরঘরে ঠেলে দেন। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির আর্তচিৎকারে মধ্যরাতেই পাড়া-পড়শিরা সে বাড়ির সামনে এসে ভিড় করে। নিরুপায় হয়ে বাড়ির লোকজন বালিকাটিকে নিয়ে যায় কলকাতা মেডিকেল কলেজে। পরদিন হতভাগিনী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে। খবরটি কাগজে আসে। বোধ করি ছেলেটি ও তার বাবা-মায়ের সামান্য শাস্তি হয়েছিল।
পত্রিকায় খবরটি ফলাও করে আসায় ইংরেজ কর্মকর্তাদের তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, ঋতুমতী হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হবে। এই নির্মম ঘোষণা বাঙালি পুরুষেরা মানবেন কেন? তাঁরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ১০০ বছর আগে এখনকার মতো যানবাহন ছিল না। থাকলে তাঁরা মোটরযান ভাঙচুর করতেন, বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দিতেন, অথবা উপড়ে ফেলতেন রেললাইন। কিন্তু যা করেছিলেন, তা হলো সারা বাংলায় প্রতিবাদ সভা। তেমনই একটি বা একাধিক হয়েছিল ঢাকা জজকোর্টের আঙিনায়। তাতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যোগ দেয়। কিশোরী বধূর চেয়ে মধুর এ জগতে আর কিছু নেই।
বিয়ের বয়স কমতে পারে, বাল্যবিবাহে সাজা বাড়ছে উল্লিখিত বালিকাটি আরও অনেকের মতো নীরবে মারা গেলে কোনো ঝামেলা হতো না। মেয়েটি ঝামেলা বাধায় চিৎকার করে কেঁদে। বিশেষ করে, পাড়ার লোকজন জড়ো হওয়ায়। অভিভাবকেরা বলতে পারেননি, বউমা রাতে শৌচাগারে গিয়েছিল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তাকে সাপে কেটেছে। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো গোখরা সাপ আছে। সাপুড়ে ডেকে মারব মারব করছিলাম, এর মধ্যে বউমা-ই চলে গেল। বাঙালি যেকোনো ব্যাপারে বানিয়ে বানিয়ে সত্যি কথা বলতে অভ্যস্ত। এবং দেশসুদ্ধ লোককে ঘাড় ধরে বা গলায় গামছা দিয়ে হলেও তা বিশ্বাস করাতে সে বাধ্য করে।
মন্ত্রিপরিষদ কয়েক দিন আগে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়া-২০১৪ অনুমোদন দিয়েছে। তাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং ছেলেদের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেদের বিয়ের অনুমোদন নেই। যদিও এই বঙ্গভূমিতে সব আইন অগ্রাহ্য করার মতো এ আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাবালক-সাবালিকা হওয়া মাত্রই দেরি করেন না অনেকের অভিভাবক।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী সরকার বাংলা কবিতা থেকে অফুরন্ত প্রেরণা পেয়ে থাকে। এবং তা শুধু সাংস্কৃতিক ব্যাপারে নয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও। ষোড়শী শব্দটি কয়েক শ বছর ধরে বাঙালি কবিদের ছিল খুবই প্রিয়। আমাদের জাতীয় কবিও তাঁর সেরা সৃষ্টিতে বলেছেন: ‘আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি।’ কবি ১৬ বছর বয়স্কার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি ও প্রেমপিরিত করে ধন্য হবেন, আর বাংলার ছোকরারা, যারা প্রথম ভোটার, বসে বসে আঙুল চুষবে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহাজোট তা বসে বসে দেখবে, তা হয় না। তাই তারা মেয়েদের বিয়ের বয়স ষোলোতে নামিয়ে আনছে।
মেয়েদের ১৬ বয়সটির প্রতি শুধু কামাতুর বাঙালি পুরুষদেরই লোভ, তা নয়। ইংরেজরাও কম যায় না। তারা ষোড়শী না বলে বলে সুইট সিক্সটিন—মিষ্টি ষোলো। তা ছাড়া, আমাদের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের ১৬ সংখ্যাটির প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থাকাই স্বাভাবিক। ওদিকে ১৬ তারিখটি জেনারেল নিয়াজিরও আমৃত্যু ভোলা সম্ভব হয়নি।
মেয়েদের সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স ১৮ বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার নির্ধারণ করেনি। তা অনেক দিন আগের সরকারের করা। সারা দুনিয়ায়

১৮ বছরের নিচের মানবসন্তানদের গণ্য করা হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক বা ‘শিশু’ হিসেবে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে তা-ই বলা আছে। আমাদের মহাজোট শুধু খালেদা জিয়াকেই যে পরোয়া করে না, তা-ই নয়, বান কি মুন বা জন কেরিকেও তোয়াক্কা করে না।
আমার ভয় ছিল, বাঙালি মেয়ের বিয়ের বয়স ১০-এ নামিয়ে আনা না হয়। কারণ, বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি ভবতারিণী ওরফে মৃণালিনী দেবীকে যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তোলেন গৃহিণী হিসেবে, তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। সুতরাং কবির প্রতি সম্মান দেখাতে সরকার নতুন আইন করতেই পারে। অবশ্য আইন প্রণয়নে এই সরকার ক্লান্তিহীন। এরপর যদি আইন হয় ছেলেদের খতনা দিতে হবে আটে এবং পরবর্তী ১০টি বছর সে পাবে বিয়ের প্রস্তুতির সময়। এখন বিয়ের বয়সের নীতিগত সিদ্ধান্তটি হয়েছে। যখন আইন হবে, তখন তাতে গায়েহলুদের বিষয়টিও থাকবে। গায়েহলুদে কত লোক খাওয়ানো যাবে, বরের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন কত কেজি মিষ্টি আনতে হবে, স্থানীয় কলেজের ‘ছাত্রনেতাদের’ কী পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে, বিয়ের অনুষ্ঠান ও বউভাত সম্পর্কেও থাকবে নির্দেশনা। বিয়ে বিষয়ে আরও নির্দেশনা থাকতে পারে। কোনো এক পক্ষ যদি রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী হয়, সে ক্ষেত্রে বিয়ে বন্ধ থাকবে না৷ শুধু খেয়াল রাখতে হবে, রাজাকার পক্ষের বার্ষিক আয় এক কোটি টাকার ওপরে কি না!
মন্ত্রিপরিষদ কাম উপদেষ্টা পরিষদের যে বৈঠকে কিশোরী বিবাহের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, তার সব পুরুষ সদস্যেরই একটি প্রবাদ মনে পড়ে থাকবে: বাঙালি নারী কুড়িতেই বুড়ি। সুতরাং বুড়িতে পরিণত হওয়ার চার বছর আগে তাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার অধিকার তার আছে।
আমাদের সুরসিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সভাতেই বিয়ের সর্বোচ্চ বয়স নিয়েও কথা তোলেন। একটি লাল পাঞ্জাবির দিকে চোখ পড়তেই তিনি সর্বোচ্চ বয়স নিয়ে কথা তোলেন। সিক্সটিফাইভ-থার্টিফাইভ অর্থাৎ ৬৫-৩৫ (ক্ষেত্রবিশেষে ৬৮-৩২)। দম্পতির বয়সের যোগফল হানড্রেড বা ১০০। বঙ্গীয় মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬-তে নামানোর তাৎপর্য হলো এই: মাননীয় মন্ত্রীর কনের বয়স যদি হয় ৩২, আমজনতার বউয়ের বয়স হবে তার অর্ধেক অর্থাৎ ১৬।
এখন থেকে বাঙালি নারী মা হবেন ১৬ বছর নয় মাসে। দুই সন্তানের জননী হবেন ১৭ বছর ১০ মাসে। মৃণালিনী দেবীর মতো ২২ বছর বয়সের আগেই চার-পাঁচ ছেলেমেয়ের মা হবেন। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাঙালি মেয়ে ১৭-তে মা, ৩৩-এ শাশুড়ি ও ৩৪-এ নানি হবেন। ৫০ বছর বয়সে নানিশাশুড়ি। ৫১-তে নাতবউয়ের কোলে পুতি দেখে তাঁর চোখ জুড়াবে।
এখন তো বাংলাদেশে জনগণ খুব পাতলা। ১৬/১৮ আইন হলে বাচ্চাকাচ্চায় ভরে যাবে দেশ। ২০২১ সালে হবে ২১ কোটি। ২০৪১-এ মহাজোটের মেয়াদ পূর্তিকালে হবে ৪১ কোটি। সরকার আমলা থেকে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত সবারই মনোবাঞ্ছা পূরণে বদ্ধপরিকর। তবে আমাদের মতো বেকুবদের মনে হয় কোনো আইন করার আগে দেশের ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা অবশ্যকর্তব্য।
দিনবদলের সরকার দিন না বদলে বদলাচ্ছে বিয়ের বয়স আর মন্ত্রণালয়ের নাম। আর বদলাচ্ছে জীবনের জরুরি বিষয়ের সংজ্ঞা: রাজনীতির সংজ্ঞা, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷