শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে গত সোমবার ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মুখে যখন পদত্যাগ করেন, তার খানেক আগেও তাঁর বাসভবনের বাইরে তাঁর সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছিলেন। এর জেরে সংঘর্ষে ক্ষমতাসীন দলের এমপিসহ পাঁচজন নিহত হন। প্রতিবাদকারীরা রাজাপক্ষের পৈতৃক বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেন। একপর্যায়ে নিরাপত্তার কারণে মাহিন্দাকে ত্রিঙ্কোমালির একটি নৌঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়।
মাহিন্দার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে কত দিন গদিতে থাকতে পারবেন, তা অস্পষ্ট। মাহিন্দার ছেলে নমল রাজাপক্ষে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন। মাহিন্দার অপর দুই ভাই বাসিল রাজাপক্ষে এবং চমল রাজাপক্ষে যথাক্রমে অর্থমন্ত্রী এবং কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে তাঁরা সরে যাওয়ার পরও বিক্ষোভকারীরা থামেননি। তাঁরা প্রতিশোধের স্বাদ পেয়েছেন এবং এখন মাহিন্দার ছোট ভাই গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবি করছেন।
এর মানে কি রাজাপক্ষে পরিবারের রাজত্ব শেষের দিকে চলে এসেছে? যে পরিবারটি ৫০ বছর ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটির ইতিহাসে তাদের সদর্প পদচিহ্ন রেখে এসেছে, তার শেষ অধ্যায়টি কি চলে এসেছে? অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে, শ্রীলঙ্কার ‘প্রধান খেলোয়াড়’ হিসেবে বিবেচিত চীন সরকারের কী ভূমিকা রয়েছে সেখানে? প্রতিবেশী দেশ ভারতই–বা কী ভূমিকা রাখছে?
ভূরাজনীতি ও ক্ষমতার প্রশ্নে একটি প্রবাদ, ‘স্থায়ী বন্ধু অথবা শত্রু বলে কিছু নেই; একমাত্র স্বার্থই সবচেয়ে বড় কথা’। গত কয়েক দশক ধরে ভারত ও শ্রীলঙ্কার পারস্পরিক সম্পর্কে এই কথা খাটে।
২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত—এক দশক মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন মাহিন্দার সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল, তা ‘স্থিতিশীল, তবে শীতল’। তখন তিনি চীনাদের আরও কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। ফলে হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে সেটি চালানোর ভার সবকিছু চীনাদের হাতে চলে গেল। এ সময় ভারতের সঙ্গে মাহিন্দার সম্পর্ক বেশ শীতল হয়ে পড়ে।
রাজাপক্ষেরা ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি অনুসরণ করেন। তামিলদের প্রাদেশিক কাউন্সিল দেওয়া হলেও তাদের হাতে প্রকৃত কোনো ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। এরপর মনমোহন থেকে মোদি—ভারতের ক্ষমতায় এলেন। তাঁরাও সংখ্যাগুরু সিংহলি কার্ডের আশ্রয় নিলেন।
মাহিন্দা ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন এবং তাঁর ভাই গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হন। এরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্রুত মাহিন্দার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। কারণ, ভারত জানত, শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল উল্লেখযোগ্য প্রভাব হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
তীব্র অর্থনৈতিক সংকট তথা খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবই যে রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভের বড় কারণ, তাতে সন্দেহ নেই। দেশটির রিজার্ভ অর্থ পাঁচ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে এবং তাঁরা জরুরি ভিত্তিতে কিছু ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে গেছেন। ভারতও এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
সিংহলি এবং তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত বিভেদরেখা রয়েছে। সেই রেখাকে আরও বাড়িয়ে রাজাপক্ষেরা নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘ করতে চেয়েছিলেন।
২০০৯ সালে তামিলদের সশস্ত্র সংগঠন এলটিটিইর বিরুদ্ধে সরকার যখন নৃশংস অভিযান চালায়, তখন আজকের প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। মাহিন্দা ছিলেন প্রেসিডেন্ট। ভারত ওই অভিযানে রাজাপক্ষেদের সমর্থন করেছিল। কারণ, তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেছিল। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত নিজেদের জন্য হুমকি মনে করত।
তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী ও শ্রীলঙ্কা সরকারের মধ্যে শান্তি স্থাপনে ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার মধ্যস্থতা করেছিল। সে সময় ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে বলা ছিল, শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল ও সিংহলিদের মধ্যে সব প্রদেশের ভূমি ও ক্ষমতা বাঁটোয়ারা করবে। এমনকি যেখানে তামিলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানেও শ্রীলঙ্কা সরকার তাঁর পুলিশ গুটিয়ে আনবে। এর বদলে তামিলরা অস্ত্র সমর্পণ করবে। সেই চুক্তি অনুসারে মাহিন্দা ভারতকে সংবিধান সংশোধনী বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর ভাই গোতাবায়া সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। তাঁরা সিংহলি জাতীয়তাবাদ নামক বাঘের পীঠে চড়ে বসেন এবং তামিলদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালান। তামিল নেতা প্রভাকরণকে সপরিবার হত্যা করা হয়।
রাজাপক্ষেরা ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি অনুসরণ করেন। তামিলদের প্রাদেশিক কাউন্সিল দেওয়া হলেও তাদের হাতে প্রকৃত কোনো ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। এরপর মনমোহন থেকে মোদি—ভারতের ক্ষমতায় এলেন। তাঁরাও সংখ্যাগুরু সিংহলি কার্ডের আশ্রয় নিলেন।
২০০৫ সালে মাহিন্দা ক্ষমতায় এসে অষ্টাদশ সংশোধনী পাস করেন, যাতে প্রেসিডেন্টের মেয়াদের সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে দেওয়া হলো। ২০১৫ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মাইথ্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঊনবিংশ সংশোধনী পাস করে সেই আইন বাতিল করলেন। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না—আগের এই নিয়মকেই পুনর্বহাল করলেন। ২০১৯ সালে গোতাবায়া ক্ষমতায় এসে আবার সেই নিয়ম তুলে দিয়ে বিশতম সংশোধনী পাস করেন।
ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য বারবার সংবিধান সংশোধন করার বিষয়টি জনগণ কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। এখন অর্থনৈতিক সংকটে যখন মানুষ দিশাহারা, তখন এ বিষয়গুলোও তাদের সামনে উঠে আসছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নতুন করে ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে দেশটিতে আগে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। কিন্তু গোতাবায়া গদি থেকে না সরা পর্যন্ত সে ধরনের কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এতে গোতাবায়ার পদত্যাগে ভেতর ও বাইরে থেকে চাপ বাড়ছে। দেশটির বেশির ভাগ মানুষ মনে করছে, আজকের এ পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে পরিবার মূলত দায়ী।
দ্য প্রিন্ট ডট ইন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
● জ্যোতি মালহোত্রা দ্য প্রিন্ট-এর একজন সিনিয়র পরামর্শক সম্পাদক