শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে একটি মুদ্রা বোর্ড দরকার

শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই দেশটির সরকারি অর্থব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবেছবি : এএফপি

ইউক্রেনের যুদ্ধ মহাজলোচ্ছ্বাসের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের মহাতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। সেই তরঙ্গ কাছে-দূরের সব দেশকেই বিধ্বস্ত করছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অর্ধেক বিশ্ব দূরে থাকা শ্রীলঙ্কার ওপর এর বড় অভিঘাত পড়েছে। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ক্রমাগত দেশটিকে অর্থনৈতিক পতনের একেবারে তলায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। এখন দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজপথ প্রতিবাদে কেঁপে উঠছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক পতন এবং আর্থরাজনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমূল পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে শ্রীলঙ্কার এই গভীরতর সংকট মোকাবিলায় একটি কার্যকর কৌশল নিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য আলোচনা হচ্ছে না। সুতরাং ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ সরকারের পরিবর্তন আনতে পারলেও তা সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে যাঁরাই দায়িত্বে আসুন না কেন, অবস্থার খুব একটা উন্নতি হবে না। ফলে শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই দেশটির সরকারি অর্থব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে এবং উদ্ভূত বিপদের গভীরতা সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটগুলোর সমাধান করতে হবে।

আরও পড়ুন

হাতে নষ্ট করার মতো সময় নেই। সবে দায়িত্ব নেওয়া অর্থমন্ত্রী আলী সাবরি বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পাঁচ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। অন্যদিকে মাথার ওপর ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের যে ঋণের বোঝা ঝুলছে, তার মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার এ বছরের মধ্যে শোধ করার কথা। অন্য সব ঋণের কিস্তি দেওয়া স্থগিত হয়ে আছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানির জন্য বিশ্বব্যাংক ৬০ কোটি ডলার দিলেও তা আর্থিক রক্তপাত বন্ধ করার জন্য খুবই অপ্রতুল।

জনসাধারণের কোষাগার খালি, ব্যাংকগুলোর অর্থ প্রদানের ভারসাম্যের চাপ বাড়তে থাকা এবং একটি বিশাল ঋণ ঝুলে থাকার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যবস্থা এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য একটি আর্থিক অবস্থা মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এ-জাতীয় পরিকল্পনায় অবশ্যই অপচয় নির্মূল করা এবং বাজেট ব্যবস্থাপনাকে কঠোর করাসহ সব মানকে একত্রকরণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শ্রীলঙ্কান রুপিকে জোরালো করতে হবে। তবে এ সবকিছু করতে হলে শ্রীলঙ্কাকে অবশ্যই একটি মুদ্রা বোর্ড স্থাপনে আরও জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি দেশে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থার মুখে এ ধরনের মুদ্রা বোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্য এসেছে। হংকংয়ে ১৯৮৩ সালে এই বোর্ড কঠিন অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯২ সালে এস্তোনিয়ায় এই বোর্ড গঠন হয়েছিল এবং তাদের সাফল্য দেখে ১৯৯৪ সালে লিথুয়ানিয়া একইভাবে মুদ্রা বোর্ড গঠন করেছিল।

এ ধরনের ব্যবস্থার অধীনে মুদ্রা বিনিময় হার আইন দ্বারা নির্ধারণ করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ভিত্তিতে সমগ্র মুদ্রাব্যবস্থা চালাতে হবে। বড় ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার সাধারণত নিজস্ব যে বিবেচনার ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে, সেই ক্ষমতা আপাতত রহিত করে তা মুদ্রা বোর্ডের হাতে দিতে হবে। দেশের প্রধান অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এই বোর্ড গঠন করতে হবে। সেই বোর্ডই সরকারকে মুদ্রাব্যবস্থা পরিচালনাসংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা দেবে। এটি করা যেতে পারলে শ্রীলঙ্কার অর্থব্যবস্থায় তুলনামূলক দ্রুততায় বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে আসবে। বোর্ডটি প্রতিষ্ঠিত হলে সেটি প্রধানত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে, বিশেষ করে রুপির পতন রোধে বিশেষ মনোযোগ দেবে।

আরও পড়ুন

একটি মুদ্রা বোর্ড হলো একধরনের শক থেরাপি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকট এটাই দাবি করছে। এটি অবিলম্বে গঠন করা যেতে পারে। এর জন্য বাজেট কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে, এমন কোনো তাৎক্ষণিক সংস্কারেরও প্রয়োজন নেই। এটিকে জরুরি কার্যকর ওষুধ হিসেবে গণ্য করে গঠন করতে হবে। এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি দেশে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থার মুখে এ ধরনের মুদ্রা বোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্য এসেছে। হংকংয়ে ১৯৮৩ সালে এই বোর্ড কঠিন অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯২ সালে এস্তোনিয়ায় এই বোর্ড গঠন হয়েছিল এবং তাদের সাফল্য দেখে ১৯৯৪ সালে লিথুয়ানিয়া একইভাবে মুদ্রা বোর্ড গঠন করেছিল।

এ কারণে সময়ক্ষেপণ না করে শ্রীলঙ্কায় জরুরি মুদ্রা বোর্ড গঠন করা দরকার।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আর এম মনিভানান শ্রীলঙ্কার প্রথম সারির একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা