আজ আমার মন শ্রাবণের মতো। ঝরছে ভালোবাসা টুপটুপ শব্দ করে। বর্ষা এল আষাঢ়ের হাত ধরে। তারপর মেঘে মেঘে ছুটে আসবে শ্রাবণ। ক্যালেন্ডারে চাপা পড়ে। গ্রেগরি সাহেব বেঁচে আছেন। বাড়ির সামনের সবুজ বৃক্ষটি অনেক আগেই জানান দিয়ে গেছে, আমি এসেছি। তোমরা দেখোনি, আমার ডালে ডালে কত বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুলের কুঁড়ি? আমার স্ত্রী কাল বিকেলে পাঁচ তলার বারান্দায় আদর করে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, আব্বাসী সাহেব, এই শত কদমের ফুল আর কোনো বারান্দা থেকে কেউ কি দেখাতে পারবে? বললাম, না। শতটি ফুল যেন আমার বারান্দার রেলিং চুম্বন করে যাচ্ছে।
ফুলের বৃন্তটি দেব কার হাতে? কেন, যাকে ভালোবেসেছিলাম? এখনো বাসি। যার সঙ্গে দিন-রাত ঝগড়া। চুয়ান্ন বছর আগে ওই গলায় মালা দিয়েছিলাম। তার আগে দিয়েছি অনেক কিছু। অনেক ভালোবাসার সংলাপ, যা এখন সংগ্রহ করেছি সর্বাধুনিক উপন্যাস: তুমি আমার-এর জন্য। কানে কানে শুনিয়েছি গান, কবিতা, বিভিন্ন কবির সংগ্রহ থেকে। ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে’। ‘বল বল বল, তুমি আমার মনের কথা জেনে ফেলেছ, ওইখানে তোমার জিৎ। আমি তোমার মনের কথা জানতে পারলাম কই’ [প্রমথনাথ বিশি]। সহস্র কবিতা, গান, আর: ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’। গাছটির পানে সস্নেহে তাকালাম। তোমাকে ভালোবাসি। প্রতিটি বাঙালি। তোমার কাছেই প্রেমের দীক্ষা। নতুন বাঙালিরা কি তোমাকে ভুলে গেল? ছাত্রছাত্রীরা চেনে না। কোনো ছাত্র আনেনি একগুচ্ছ কদম ফুল সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওদের জানালাম, কদম ফুলের কথা, যেন চিনতেই পারল না, যেন বিদেশিনী ফুল। ও গো কদম ফুল, যেন তুমিই প্রথম ভালোবাসার পঙ্ক্তি।
কেন, আমার গানের খাতাতেই তুমি বেঁচে আছ, থাকবে কদম ফুল ও কেয়া ফুলের গন্ধ। ‘গীতবিতান’জুড়ে ফুলগুলো সুবাস ছড়িয়েছে। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।/ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়’। সন্ধ্যা হলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। গাইছি: ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা’। ‘আমার প্রিয়ার ছায়া আকাশে আজ ভাসে, হায় হায়!’। কত গান! কে শুনবে সে গান?
আছে আরও: ‘প্রাণ সখীরে, ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’। কদম ফুল, তুমি জানো, ঘুরে বেরিয়েছি বংশীর খোঁজে দেশে দেশে, তাদের নিয়ে কেটেছে অনেক প্রহর। তবু ফিরে আসি এই কদম্বতলেই, প্রেমিককে ফিরে আসতেই হয় বিচ্ছেদির কাছে। বিচ্ছেদির অন্যতম প্রহরী, আমার কাছেই সহস্র গান, যা ধ্বনিত শত বছর ধরে লোককবিদের কণ্ঠে, পিতার কণ্ঠে, ভগ্নির কণ্ঠে, কন্যার কণ্ঠে, ভ্রাতুষ্পুত্রীর কণ্ঠে, শত ছাত্রছাত্রীর কণ্ঠে। এ গান মরে যাবে না। কদম, তুমি যেদিন ফুটবে, সেদিনই আমার হাতে থাকবে তোমার একটি ডাল। ভালোবাসার জনকে মহামূল্য কিছু দিতে পারব না। দোকানগুলো বড়লোকদের করায়ত্ত। ওখানে কদম খুঁজে পাব না। হে কদম বৃক্ষ, আমার জন্য রেখো শুধু দুটি ফুল, যাকে ভালোবাসি তার জন্য। ভালোবাসার রং বদলায়, সেটি কি আমার দোষ? যাকে সারা জীবন ভালোবেসেছি, সে এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। বলে, ওই ফুল দুটি কি আমার জন্য নয়? দাঁড়ায় কন্যারা। তার মধ্যে একজন বিদেশে থাকে। বলে, এ ফুল আমার জন্য। নাতি-নাতনিরা অনুযোগ করে। বলে, নানা, এটি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দিতে পারবে না। দেশে-বিদেশে অনুরাগী। বলে, ফুলটি দেখিনি। যদি ভালোবাসো, আমাকেও দিয়ো। কথা দিয়েছ, তুমি শুদ্ধ প্রেমিক।
আজ শ্রাবণের ঘন মেঘের আড়ালে খুঁজি সেই ফুল, গন্ধ নেই, পাপড়ির পর পাপড়ি। পিঁপড়াই ভালোবাসা। আছে মেঘ মেদুর আকাশে হঠাৎ চমকে যাওয়া মেঘ গর্জন। হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছি কবিগুরুর গান। চোখের পাতা ভিজে যায়, কার জন্য জানি না। কবির চোখের পাতাও কি ভিজে গিয়েছিল? কার জন্য? গাইছি, পিতার ফেলে যাওয়া গান: ‘আমার কার জন্য প্রাণ এমন করে, তোরা কিছুই জানিস নাকি/ কী বলব গো প্রাণসখী’?
ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও অস্ট্রেলিয়ায় আছে কদম, আছে কৃষ্ণচূড়া। তাহলে ওখানেও ভালোবাসার লোক আছে? বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছে: ‘নিওলা মার্কিয়া কদম্ব’। ভালোবাসার রং যেমন এক হয় না, তেমনি। নামও আলাদা। কোনোটির নাম: গুলি কদম, কেইম, গিরি কদম। হিন্দুরা কদম ভালোবাসে। কৃষ্ণ দেব ও রাধা ফুলটির অনুরাগী। সহস্র গানে ফুলটির নাম। কদম্বতলেই তাদের প্রেম উপাখ্যান। মজা হলো শত বছর ধরে যাঁরা গান লিখেছেন, তাঁরা মুসলমান। তাঁদের কাছে রাধা ও কৃষ্ণ দেবতা নয়, ভালোবাসার অমূর্ত ছবি। কদম ফুলের কথা অবশ্যই ‘ভগবত পুরাণে’ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদেরটা হলো মানবিক ভালোবাসা, মানুষ ভালোবাসি। কবি যেমনটি গেয়েছেন: ‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শত বার, জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার’। যেদিন ‘ভগবত পুরাণ’ ছিল না, সেদিনও মানুষ ভালোবাসত, সেদিন কদম ছিল।
ভ্রমরার আকর্ষণ কদম, কাজ: মধু আহরণ, দিবারাত্রি মধুর খোঁজে। এত আহরণ, তবু ফুরায় না। গবেষণায় নেই বিরাম। রোগের নিরাময় খুঁজে বের করছেন চিকিৎসকেরা। ডায়াবেটিস, জ্বর, সর্দি, হলে কদম্বগাছের ছাল কাজ দেবে ধন্বন্তরির মতো। আর বলব না, তা না হলে বাসার সামনের গাছটি আক্রান্ত হবে। ওরা ফুলের ভালোবাসা চায় না, চায় ওষুধ। ভালোবাসার ওষুধ কেউ চেনে না।
ভালোবাসার রোগ ছড়িয়ে দিয়ে গেল কদম ও কেয়া। লিখছেন গালিব, প্রেমময় কবি। গালিব ভালোবাসলে বইয়ের পাতাটি খুলুন: ‘গালিবের হৃদয় ছুঁয়ে’। তিনি বলছেন: ‘এ রোগ আমার ভালো হওয়ার নয়। কেন এই সাদা ওড়না পরা রমণী আকর্ষণ করে ফুলের পাপড়ির মতো। আমার কী দোষ?’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।