পশ্চিমা সমাজে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসীদের ওপর যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার তালিকা দীর্ঘ। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলাকে সেই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন বলা যেতে পারে।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের হুমকি ক্রমশ বাড়তে থাকার পরও পশ্চিমা সরকারগুলো এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক যতগুলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেই লম্বা তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে: ২০১৮ সালে পেনসিলভানিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইহুদি উপাসনালয়ে ঢুকে রবার্ট গ্রেগরি বাওয়ার নামের এক ব্যক্তি এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে উপাসনারত ১২ ইহুদিকে মেরে ফেলেন; ২০১৭ সালে কুইবেক সিটি মসজিদে ঢুকে আলেক্সান্ডার বিসোনেট নামের এক ব্যক্তি গুলি করে ছয় মুসল্লিকে হত্যা করেন; ২০১৫ সালে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার চার্লসটোনে গির্জায় ঢুকে ডাইল্যান রুফ নামের এক ব্যক্তি গুলি চালিয়ে ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মযাজককে হত্যা করেন এবং ২০১১ সালে নরওয়েতে অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে মেরে ফেলেন।
সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টারের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ধরনের বহু হামলা পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে, যেগুলো সংঘটিত হলে কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক প্রাণ হারাত। গত মাসেই এফবিআই ক্রিস্টোফার পল হ্যাসোন নামের মার্কিন কোস্টগার্ডের একজন লেফটেন্যান্টকে গ্রেপ্তার করে। পল হ্যাসোন একজন কট্টর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী লোক। এফবিআইয়ের দাবি, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ এবং উদার রাজনীতিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
এসব ঘটনা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় গড়ে উঠেছিল উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সংগঠন কু ক্লাক্স ক্লান (কেকেকে)। তাদের হামলায় এই দুই শতকে লাখ লাখ আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মারা গেছে। আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনাবেচা নিয়ে তারা যুগের পর যুগ অশ্বেতাঙ্গদের ওপর জুলুম করে এসেছে। পশ্চিমা উপনিবেশের চূড়ান্ত উৎকর্ষের সময় লাখ লাখ অশ্বেতাঙ্গকে হত্যা করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা এ বিষয়ে একমত যে আফ্রিকান দাস ব্যবসা এবং পশ্চিমা উপনিবেশবাদ—এই দুইয়ে মিলে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে শক্তিশালী করেছে। আমেরিকার গণমাধ্যম ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে গবেষণায় যথেষ্ট সময় ব্যয় করে। কিন্তু সেই তুলনায় উগ্র ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ততটা নয়।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী হামলা হয়, তার দুই–তৃতীয়াংশ হামলা চালায় উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্যক্তি কিংবা গ্রুপগুলো। সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টারের গবেষণা বলছে, কট্টর দক্ষিণপন্থীদের সহিংসতার সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের যোগসাজশ রয়েছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস–এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুগ যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলপত্রে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এর সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।
শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাকে যতখানি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার, ততখানি গুরুত্ব দিয়ে কেন দেখা হচ্ছে না, তা হয়তো রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করলে বোঝা সহজ হবে। বিশেষ করে যখন বহু পশ্চিমা রাজনীতিবিদকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসীদের দলে দেখা যায়, তখন বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে।
শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ ইউরোপ ও আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে বহু আগে থেকেই শেকড় গেড়ে বসে আছে। ইউরোপে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। ভোটের মাঠে তারা বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটের ফল তার বড় উদাহরণ। অন্যদিকে আমেরিকায় দেখা যাচ্ছে, খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অসংখ্য রিপাবলিকান নেতার সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের যোগ রয়েছে।
নব্য কেকেকের সাবেক প্রধান (গ্র্যান্ড উইজার্ড) এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী নেতা ডেভিড ডিউক ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সমর্থন করেছিল এবং ডিউকের সমর্থন অস্বীকার করতে রাজি না হওয়ায় কেন ট্রাম্প সব পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন, তা ডিউক ব্যাখ্যা করেছেন।
২০১৭ সালে ট্রাম্প কোনো রকম রাখঢাক না করেই কেকেকের প্রতি তাঁর সমর্থন প্রকাশ করেন এবং ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে এলাকায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লোকজনকে ‘খুব সজ্জন লোকজন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
চলতি দশকের গোড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মার্কিন নাগরিকত্ব, তাঁর বোধবুদ্ধি ও জাতপাত চ্যালেঞ্জ করেও চূড়ান্ত রকমের নেতিবাচক প্রচার চালিয়েছিলেন ট্রাম্প। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ মানুষ অশ্বেতাঙ্গদের তাদের চেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন মনে করে। এ ছাড়া অশ্বেতাঙ্গদের তারা হুমকির কারণ বলেও ভাবে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় সাদা-কালো বৈষম্য না থাকার বিধান থাকার পরও দেখা যায়, ঋণ কিংবা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গদের বেশি বেগ পেতে হয়। নিউজিল্যান্ডে মসজিদের মধ্যে যে গণহত্যা হলো, তা থেকে আন্দাজ করা যায়, পশ্চিমা সমাজের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মুসলিম এবং অভিবাসন পাওয়া তামাটে চামড়ার মানুষকে পুরোপুরি মানুষ মনে করে না। তারা তাদের মনে হয় ‘সাব হিউম্যান’ বা ‘ঊনমানুষ’ বলে ভাবে।
নিউজিল্যান্ডের এই গণহত্যার ঘটনার সঙ্গে আরেকটি সমস্যার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেটি হলো সংবাদ পরিবেশনের ধরন। পশ্চিমা গণমাধ্যমে মুসলমানদের বিষয়ে প্রায়ই নেতিবাচক ভঙ্গিমা প্রকাশ করে থাকে। মুসলিমরা অপরাধ করলে সেটি ফলাও করে প্রচার করা হয়। ঠিক একই অপরাধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হলে সেই খবর ততটা গুরুত্ব পায় না।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো অমুসলিম কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটালে সংবাদমাধ্যম যতখানি গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রকাশ করে, সেই একই ঘটনা কোনো মুসলিম ঘটালে তা তার চেয়ে ৩৫৭ গুণ বেশি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা হয়। এর বাইরে অমুসলিমদের সহিংসতা–সংক্রান্ত খবরে প্রায়ই ‘টেররিজম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হলে প্রায় অনিবার্যভাবেই এই শব্দটির ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়া কভারেজ—এই দুই শক্তি মূলত পশ্চিমা সমাজে মুসলিম, অশ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে।
আজকে যে লোকটি গুলি করে এতগুলো মানুষ মেরে ফেলেছেন, তিনি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁকে তঁার সমাজ অশ্বেতাঙ্গদের বিষয়ে যে ধারণা দিয়েছে, সেই ধারণা থেকেই তিনি এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। এর থেকে মুক্তি পেতে সেই অশুভ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণাকে বদলাতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মোহাম্মাদ আল মাসরি : নর্থ আলাবামা ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশনস বিভাগের ফ্যাকাল্টি মেম্বার এবং দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের মিডিয়া অ্যান্ড কালচারাল প্রোগ্রামের প্রধান