১৯ জানুয়ারি সারা দেশে ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল। এই কর্মসূচির সব সজ্জা শেষ হলেও ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে স্থগিত করেছে নতুন মন্ত্রীদের পুরোনো প্রশাসন। এসডিজির মূল বার্তা ‘কেউ যেন বাদ না পড়ে’ মাথায় রেখে স্থায়ী টিকাকেন্দ্র ছাড়াও বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, ব্রিজের টোল প্লাজা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, খেয়াঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে ও ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল।
বিতরণের জন্য পাঠানো ক্যাপসুল হাতে পাওয়ার পর সরাসরি বিতরণব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত মাঠের কর্মী ও কর্মকর্তারা ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রথম আওয়াজ তোলেন। কেউ বলছেন, ক্যাপসুলে ছত্রাক দেখা গেছে। কারও ভাষায়, এক ক্যাপসুলের সঙ্গে আরেক ক্যাপসুল জোড়া লেগে গেছে। প্রকৃতির ফলমূল জোড়া লাগে, মানুষ জোড়া লাগা দুটো কলাকে একটা কলা বিবেচনা করে আর বিক্রেতা রাখেন একটার দাম। কিন্তু ক্যাপসুলে তো আর সেই সূত্র খাটে না। তাতেই বেধেছে গোল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্যাপসুল পরীক্ষা করার পর বলা যাবে, এর মান খারাপ ছিল কি না।
যাঁদের স্মৃতি এখনো বেইমানি করা শুরু করেনি, তাঁরা মনে করতে পারেন, ২০০৯ সাল থেকে চলছে একই কেচ্ছা, একই কাহিনি। ২০০৯ সালের ৬ জুন ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের সময় শিশুদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। তখনো সরকার পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। পরিস্থিতি শান্ত হলে, সংবাদটির আবেদন প্রায় হারিয়ে গেলে, তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়েছিল, ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক বড়ি খেয়ে কোনো শিশুর মৃত্যু হয়নি। শিশুমৃত্যু সম্পর্কে গণমাধ্যমে ভিত্তিহীন খবর প্রচারিত হয়েছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। তদন্ত কমিটি এ ধরনের ভিত্তিহীন খবর আর গুজব মোকাবিলার জন্য সুপারিশে বলে, কর্মসূচির আগে ও পরে প্রশাসন, গণমাধ্যম, জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় ও যোগাযোগ করা প্রয়োজন। ১২ দফা সুপারিশের এটাই ছিল মর্ম কথা। বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এরপর ২০১২ সালের ২ জুন দেশব্যাপী ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন কর্মসূচি পালিত হয়। ছয় মাস পর ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ঠিক করা হয়। তখন আবার ক্যাপসুলের মান নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। ভারত ও সিঙ্গাপুরে দুই দফা মান পরীক্ষা করার পর ১২ মার্চ শিশুদের তা খাওয়ানোর দিন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সে সময় অপপ্রচার এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার কারণে বহু অভিভাবক শিশুকে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাননি। আবারও শিশুমৃত্যুর গুজব ছড়ায়। পরের দিনের সংবাদপত্রে ছাপা হয়, ক্যাপসুল খাওয়া শিশুদের আতঙ্কিত অভিভাবকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতালে পড়ে ছিলেন। সেবারও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্যসচিবের কাছে প্রতিবেদনও জমা দেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পাননি। এ বিষয়ে তদানীন্তন স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজউদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি মূল প্রশ্ন এড়িয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু যাঁরা জানতে চেয়েছেন, তাঁদের জানানো হয়েছে। এই ঢাক ঢাক গুড় গুড় পরিস্থিতির ঘোর কাটতে না কাটতেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই সচিব তাঁর চাকরি হারান। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশও আর আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ ছিল, এই কমিটি ঢাকায় বসেই প্রতিবেনদ তৈরি করেছিল। গুজব আর আতঙ্কিত মানুষেরা দূরে থাক, জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সরাসরি কোনো কথা কমিটির সঙ্গে হয়নি। কমিটিতে সরকারের বাইরের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
এবারও দুটো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন—এমন বিজ্ঞানীদের এসব কমিটিতে রাখা হবে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান বলেছেন, ‘আদালতে মামলা করে ভারতের এক অখ্যাত কোম্পানি নিম্নমানের ভিটামিন এ ক্যাপসুল কিনতে আমাদের বাধ্য করেছে।’ ১৮ জানুয়ারি বেলা পৌনে তিনটার দিকে কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসে বিতরণের জন্য জেলা–উপজেলায় প্রেরিত ভিটামিন এ ক্যাপসুলের নমুনা পর্যবেক্ষণের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি জানান, ভারতীয় ওই কোম্পানির কোনো সুনাম নেই। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমাদের ওষুধ খাত ক্রমেই উন্নতি করছে বলে প্রায়ই খবর প্রচার করা হয়। রপ্তানিদ্রব্যের মধ্যে ওষুধ ক্রমেই বড় জায়গা করে নিচ্ছে। দেশি প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন ভিটামিন এ ক্যাপসুল তৈরি করে সর্বনিম্ন দরদাতা কেন হতে পারে না, তা যাচাই করা উচিত। একজন পাঠক তাঁর নিজস্ব মতামতে লিখেছেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি নিজে এই ওষুধ উৎপাদন করে না। তারা চীন থেকে কিনে এনে সরবরাহ করে। অভিযোগটি খতিয়ে দেখা উচিত। কে তাদের কাজ দিল, সেই প্রশ্নও মোটেই এড়ানো যাবে না। দাতাদের শর্তে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ওষুধ কেনার রেওয়াজ থাকলেও শুধু যোগ্য ও প্রকৃত উৎপাদনকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সীমিত রাখার ব্যবস্থা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব রাখে এবং তাদের তালিকা হালনাগাদ করে। এই তালিকার মধ্যে প্রতিযোগিতা সীমিত রাখলে দুষ্ট লোকদের পক্ষে বদনামের ঢিল ছোড়া কঠিন হবে। আমাদের শিশুরা রক্ষা পাবে। সরকারের সাদা গায়েও কাদা লাগবে কম।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক