আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার আহ্বান জানালেন, সেই অনুষ্ঠানেই ঘটনাটি ঘটল।
৫ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই অনুষ্ঠানের খবরটির শিরোনাম ছিল ‘শোক দিবসের আলোচনায় আশরাফ: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভক্তি চায় না আওয়ামী লীগ’। খবরে ৪ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় সৈয়দ আশরাফ আরও বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা কোনো তর্ক-বিতর্ক দেখতে চাই না। আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। বিভাজন চাই না।’ কিন্তু অত্যন্ত সময়োচিত ও প্রত্যাশিত এই বক্তব্যকালে সেখানে কী ঘটল?
যুগান্তর শিরোনাম করছে ‘শোকসভায়ও চেয়ারে বসা নিয়ে মারামারি’। খবরের সঙ্গে একটি ছবিও ছেপেছে যুগান্তর। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার শোক দিবসের আলোচনা সভায় সামনে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের পর সভাস্থলে পড়ে আছে ভাঙা চেয়ার।’
সন্দেহ নেই, চেয়ার দখল নিয়ে মারামারির ঘটনা কেবল জাতীয় শোক দিবসের গাম্ভীর্যকেই নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মূল্যবান বক্তব্যকেও ফিকে করে দিয়েছে।
জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মতলববাজের চাঁদাবাজি, আলোচনা সভার মঞ্চ ও আসন দখল নিয়ে মারামারি বা শোক মিছিল শেষে খাবারের প্যাকেট বিতরণের সময় দুই পক্ষের হাতাহাতি এবং শোভাযাত্রার ব্যানারে সামনে দাঁড়ানোর জন্য নির্লজ্জ ঠেলাঠেলির অসংখ্য খণ্ডচিত্র আমরা গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই প্রচারমাধ্যমে দেখে আসছি। শোক প্রকাশের এই সংস্কৃতি কীভাবে জাতীয় ঐক্যকে ধারণ করতে পারে?
শতবর্ষ আগেও উত্তর ভারতসহ অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণির পেশাজীবী মানুষ বাস করত। এদের বলা হতো ‘রুদালি’। ‘রুদালি’ শব্দের অর্থ হলো যারা রোদন করে বা কাঁদে। রাজা বা জমিদারবাড়িতে কোনো নিকটজনের মৃত্যু হলে সাধারণত কাঁদার লোক পাওয়া যেত না। প্রজাদের কাছে রাজা বা জমিদারদের যে ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে, তাতে তারা তো প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে না। এতে প্রজাকুলের কাছে তাঁদের মর্যাদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এদিকে মৃত ব্যক্তির জন্য কেউ না কাঁদলে তিনি স্বর্গবাসী হবেন কী করে? অতএব ডাক পড়ত রুদালিদের। রুদালিরা দল বেঁধে এসে সারা দিন কেঁদে দিয়ে যেত। বিনিময়ে কিছু আটা-চাল বা পয়সা জুটত তাদের। হিন্দি, উর্দু ও বাংলা সাহিত্যে এই রুদালিদের নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস আছে। বছর ১৫ আগে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর টিনশেড হলে ভারতের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ঊষা গাঙ্গুলির নির্দেশনায় রুদালি নাটকে অভিনয়ের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা।
>এবারও জাতীয় শোক দিবসকে উপলক্ষ করে দেশব্যাপী সর্বত্র জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানিয়ে লাখ লাখ ব্যানার ঝোলানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, যিনি ব্যানারটির খরচ জুগিয়েছেন, তাঁর নামই ব্যানারে মুখ্য হয়ে উঠছে
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত রুদালিরা হারিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে শোকের মাস এলে বোঝা যায় এখানে একশ্রেণির ‘নব্য রুদালি’ গজিয়ে উঠেছে। পেশাজীবী রুদালিরা মেকি কান্না কাঁদত। এই নব্য রুদালিরাও মেকি কান্না কাঁদে। তবে প্রকৃত রুদালিদের সঙ্গে নব্য রুদালিদের পার্থক্য এই যে রুদালিরা পেটের দায়ে মেকি কান্না কাঁদত। অন্যের জন্য তারা কাঁদত, কিন্তু নিজেদের নিকটজনের জন্য তাদের কাঁদার কেউ ছিল না। দেশের নব্য রুদালিরা কিন্তু পেটের দায়ে কাঁদে না। সাধারণের তুলনায় তাদের অঢেল আছে। কিন্তু তাদের আরও চাই, তাই তারা কাঁদে। তারা বেশ মতলববাজও বটে। ঠিক বুঝতে পারে, কখন কাঁদতে হবে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শবাদীরা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর কিন্তু এই ‘রুদালিদের’ টিকিটিও মেলেনি।
ক্ষমতার নানা স্তরে এই মেকি কান্নাবাজদের যথেষ্ট কদর আছে বলেই এরা বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। ওপরের স্তরের নেতাদের কাছে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি তুলে ধরার জন্য নিচের স্তরের নেতারা এই রুদালিদের ‘ভাড়া’ করে আনে এবং নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে লাগায়। অসুস্থ ভোগবাদী এই প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে শোকের তাৎপর্য যায় মিলিয়ে।
কেবল দল নয়, জনপ্রশাসনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান-সংগঠনেও চলে একই প্রতিযোগিতা। ভেতরে চেতনা নেই, অথচ স্বার্থ হাসিলের জন্য মোসাহেবি করতেই হবে। আর তা করতে গিয়ে অনেকে বোধশক্তিও হারিয়ে ফেলে। গত বছর জাতীয় শোক দিবসের আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি জানান দেওয়ার জন্য একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠান। আমন্ত্রণপত্রের ভাষাটা এ রকম: আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমী নিম্নরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে...ইত্যাদি ইত্যাদি। শোক দিবসে আনন্দ প্রকাশের এহেন ভাষা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর নেতাদের চোখে পড়ে। তাঁরা আমন্ত্রণপত্রের কপি সংযুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের কাছে ওই কালচারাল অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তাতে অবশ্য কালচারাল অফিসারের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগও ছিল। বিষয়টি শিল্পকলা একাডেমীর পরিষদ সভায়ও আলোচিত হয়। এ পর্যন্তই। কালচারাল অফিসার এখনো বহাল তবিয়তে রাজশাহীতে অবস্থান করছেন।
সংস্কৃতির মানুষেরাই যখন শোক দিবসে আনন্দ প্রকাশ করে, তখন সামনের আসনে বসা নিয়ে মারামারিওয়ালাদের দোষ ধরার উপায় থাকে কী? এই সংস্কৃতিতে জাতীয় ঐক্যই বা কীভাবে সম্ভব? আসলে কীভাবে জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হয়, তা যেন আমরা ভুলতেই বসেছি। এখন যা ঘটছে, তাকেই আমরা শ্রদ্ধা জানানোর মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে ফেলেছি।
জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র বিভিন্ন দিবসে আমরা কী দেখি? শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে আমরা যখন ফুল নিয়ে যাই, তখন আমাদের সংগঠনের ব্যানার বহন করতে হয়। আবার ফুলের ডালায়ও লেখা থাকে সংগঠনের নাম। আর এই প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করেই ব্যানারে চলে এসেছে ব্যক্তির নাম। এবারও জাতীয় শোক দিবসকে উপলক্ষ করে দেশব্যাপী সর্বত্র জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানিয়ে লাখ লাখ ব্যানার ঝোলানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, যিনি ব্যানারটির খরচ জুগিয়েছেন, তাঁর নামই ব্যানারে মুখ্য হয়ে উঠছে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াচ্ছে যে যাঁর বা যাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন, তিনি বা তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন, ব্যক্তি ও সংগঠন প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গেল জুনে ইতালির রোমে কয়েক দিন কাটিয়েছি। রোমের জোনা কাসিয়া বা কাসিয়া এলাকার ভিও ভিতা সিনিসিতে ছিল আমার অবস্থানস্থল। সেখান থেকে সামান্য দূরে রয়েছে একটি পার্ক। পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন আমাকে বের হতে হতো। কয়েক বছর আগে ওই রাস্তায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক কিশোরের মৃত্যু হয়। যে স্থানে তার মৃত্যু হয়েছে, সেখানে রাস্তার ঠিক পাশেই এক কোনায় যত্ন করে রাখা আছে ওই কিশোরের ব্যবহৃত শার্ট, হেলমেট, কেডসসহ অন্য ব্যবহৃত সামগ্রী। প্রতিদিনই লক্ষ করেছি, কেউ না কেউ ঘটনাস্থলে এক বা দুই গুচ্ছ ফুল রেখে গেছেন। দুর্ঘটনার পরদিন থেকেই এটা শুরু হয়েছে। হয়তো বছরের পর বছর এই স্মরণ-প্রক্রিয়া চলবে। এখানে কেউ ঘটা করে আসেনি। আসেনি ব্যানার নিয়ে। ফুলের তোড়ার সঙ্গেও কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের নাম নেই। কিশোরটি আমার কেউ নয়। কিন্তু মাত্র ওই কয় দিনে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, সে আমার পরিবারেরই একজন ছিল। আমার ধারণা, ওখানে যদি মিছিল বা ব্যানার দেখতাম, ওই সন্তানটিকে এভাবে আপন মনে হতো না।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।