সম্প্রতি বাংলাদেশে তেল–গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশে তার অধীনে বিদ্যমান তিনটি গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ একটি চীনা তেল কোম্পানির কাছে ২০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে হস্তান্তর করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এই সংবাদ প্রথমবার প্রকাশ করে, যদিও বাংলাদেশ সরকার বা পেট্রোবাংলা এ বিষয়ে কোনো কিছু জানে না বলে সংবাদমাধ্যমে জানায়। পরে শেভরন হিমালয় এনার্জি (চীনা সরকারি ঝেনহুয়া অয়েল এবং বিনিয়োগ ফার্ম সিএনআইসির সমন্বয়ে গঠিত) নামে ওই চীনা কোম্পানির কর্মকর্তাদের একটি দলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে গ্যাসক্ষেত্রসমূহ দেখায় এবং এ বিষয়ে বাণিজ্যিক লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চীনা কোম্পানি ও শেভরনের মধ্যে ওই গ্যাসক্ষেত্রসমূহ হস্তান্তর করার চুক্তি সম্পন্ন হয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ড—সবই হয় বাংলাদেশ সরকার বা পেট্রোবাংলার অগোচরে, যদিও শেভরনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পিএসসি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শেভরন তার চুক্তিভুক্ত গ্যাসক্ষেত্র অন্য কোনো কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে তার জন্য প্রথমে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিতে হবে। যদিও শেভরন বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি, সংবাদমাধ্যম সূত্রে বিষয়টি জানার পর বাংলাদেশ শেভরনের কাছ থেকে গ্যাসক্ষেত্রসমূহ অর্থমূল্যের বিনিময়ে নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং এ মূল্য কত হতে পারে তা মূল্যায়নের জন্য একটি ব্রিটিশ পরামর্শক নিয়োগ করে। কিন্তু বাংলাদেশের এ আগ্রহকে অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই শেভরন চীনা কোম্পানির কাছে গ্যাসক্ষেত্র হস্তান্তর করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, যা শেভরন শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলাকে জানায়। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, শেভরনের এহেন কর্মকাণ্ড কেবল আইনবহির্ভূতই নয়, বরং তা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বটে। বাংলাদেশ সরকার বা পেট্রোবাংলার তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করাটা দেশীয় কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে।
বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র এবং এই একটি গ্যাসক্ষেত্র থেকেই বাংলাদেশে দৈনিক মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪৫ শতাংশ গ্যাস উৎপাদিত হয়। শেভরনের হাতে থাকা অপর দুটি গ্যাসক্ষেত্র মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রসমূহ অপেক্ষাকৃত ছোট এবং বিবিয়িনাসহ এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন দেশে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ৬৬ শতাংশ গ্যাস উৎপাদিত হয়। স্বভাবতই শেভরনের সরবরাহকৃত গ্যাস বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস–সংকটের দিনে বিশেষ অবস্থান অধিকার করে রয়েছে। তবে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে মতপোষণকারী বিশেষজ্ঞদের মতে, শেভরনের হাতে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতা থাকার ফলে দেশে গ্যাস কার্যক্রমে দেশীয় কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ গ্যাসক্ষেত্রসমূহ বাংলাদেশ নিজে চালালে গ্যাসের শতভাগ নিজেই পেত কিন্তু বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকার ফলে প্রথম থেকেই উৎপাদিত গ্যাসের একটি অংশ বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দিতে হয়, যা কিনা বাংলাদেশ আবার শেভরনের কাছ থেকে কিনে নেয়।
পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞদের মতে, শেভরন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে অতিরিক্ত হারে গ্যাস উৎপাদন করার ফলে গ্যাসক্ষেত্রটির ক্ষতিসাধন হয়েছে। শেভরন বিষয়টি মানতে নারাজ। তাদের মতে, বাংলাদেশের সুপারিশ ও চাহিদা অনুযায়ী শেভরন এই উচ্চহারে গ্যাস উত্তোলন করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে দেশি কোম্পানির অধীনে পরিচালিত তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিছুটা বড়, কিন্তু এটি থেকে গ্যাস উৎপাদনের দৈনিক হার বিবিয়ানার তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি প্রায় ৪৫ বছর ধরে গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। তুলনায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১০ বছর যাবৎ গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শকদের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটিতে অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০২২ বা ২০২৩ সাল নাগাদ উৎপাদন ক্ষমতা সহসাই অতি দ্রুত ও বিপুলভাবে কমে যাবে এবং তা নিঃশেষ হওয়ার পথে এগোবে। কোনো কোনো সূত্রমতে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস স্তরের নিজস্ব চাপ কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদন হার অব্যাহত রাখার জন্য দু-এক বছরের মধ্যে উৎপাদন কূপসমূহে ব্যয়বহুল কম্প্রেসর স্থাপন করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিবিয়ানাসহ শেভরনের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে ভিন্নমত লক্ষ করা যায়। প্রথমত, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনে আগামী পাঁচ বা ছয় বছরের মধ্যে বড় আকারের ধস নামবে বলে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তার অর্থ গ্যাসক্ষেত্রটি তার বার্ধক্য অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছেছে। গ্যাসক্ষেত্রটির ভেতর গ্যাসস্তরের চাপ হ্রাস পাওয়ার ফলে দু-এক বছরের মধ্যে উৎপাদন কূপসমূহে কম্প্রেসর বসানোর যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে, তার জন্য বড় আকারের আর্থিক বিনিয়োগ দরকার হবে। যদি তা-ই হয় তবে বিশাল অঙ্কের অর্থমূল্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের পক্ষে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি নেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু তা বিবেচনার বিষয়। উল্লেখ্য, উৎপাদনে অংশীদারত্বের চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি কর্তৃক খরচ উশুল (কস্ট রিকভারি) পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে বিবিয়ানা গ্যাসের ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং বাংলাদেশ বর্তমানে উৎপাদিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ পেয়ে থাকে ও শেভরন পায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের পক্ষে গ্যাসক্ষেত্রটি নিয়ে নেওয়া তখনই লাভজনক ছিল যখন গ্যাসক্ষেত্রটি নতুন ও তেজি অবস্থায় ছিল এবং যখন উৎপাদিত গ্যাস ভাগাভাগিতে বাংলাদেশের ভাগ কম ছিল। যে গ্যাসক্ষেত্রটি অদূর ভবিষ্যতে উৎপাদনের তেজি ক্ষমতা হারাবে, যে গ্যাসক্ষেত্রটিতে শিগগিরই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে এবং যেটি থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ সুবিধাজনক হারে গ্যাসের ভাগ পেয়ে থাকে, বিপুল অর্থ খরচ করে সেটির দায় নিয়ে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা পাবে তাই প্রশ্ন।
এদিকে মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটির উৎপাদন ক্ষমতা বহুলাংশে কমে গেছে। কয়েক বছর আগে এই গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন হার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও তা বর্তমানে কমে দৈনিক ৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছেছে। নতুন কূপ খননে গ্যাসক্ষেত্রটিতে নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই এ ক্ষেত্রেও বলা যায় গ্যাসক্ষেত্রটি তার বার্ধক্য পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আর জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি শেভরন তার বিনিয়োগ ও অনুসন্ধান দ্বারা আবিষ্কার করেনি বরং এটি বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র ছিল। এটিকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে শেভরনকে দেওয়া হয় পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে। যে গ্যাসক্ষেত্রটি বাংলাদেশের নিজস্ব ছিল এবং যেটি বাংলাদেশ নিজে উন্নয়ন করে শতভাগ গ্যাস নিতে পারত, সেটি শেভরনকে দিয়ে সেই গ্যাস ভাগাভাগি করা হয় দীর্ঘ দিন যাবৎ। আর এখন গ্যাসক্ষেত্রটির পড়ন্ত বয়সে আবার অর্থের বিনিময়ে সেই গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে নেওয়ার অর্থ নেহাতই অবিবেচনাপ্রসূত। কথাটি দাঁড়ায় এ রকম যে বাংলাদেশ তার একটি নতুন তেজি গ্যাসক্ষেত্র শেভরনকে দিয়ে বলল, এসো আমরা গ্যাস ভাগাভাগি করে নিই, তারপর একসময় যখন গ্যাসের পড়ন্ত অবস্থা তখন আবার সেই গ্যাসক্ষেত্র অর্থের বিনিময়ে নিজের কাছে নিয়ে শেভরনকে দায়মুক্ত করল!
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে চীনা কোম্পানি কেন এই গ্যাসক্ষেত্রসমূহ নিতে আগ্রহী? লক্ষণীয়, চীনা কোম্পানিটি সরকারি ও তার বিনিয়োগ পার্টনার সামরিক খাতে বিনিয়োগকারী সংস্থা। এখানে চীনের শতভাগ আগ্রহ বাণিজ্যিক নয় বরং কতকটা ভূরাজনৈতিক। বাংলাদেশকে চীন তার প্রভাববলয়ে রাখতে গিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সুবিধা করে উঠতে পারছে না। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করার জন্য অর্থ নিয়ে বসে থাকলেও চীন তা করতে পারেনি। তাই চীন সম্ভবত বাংলাদেশের জ্বালানি ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায় না।
শেভরন জানায় যে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি শেভরনের বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে তাদের সম্পদ গুটিয়ে নিয়ে অন্য স্থানে লগ্নি করার সিদ্ধান্তের অংশবিশেষ। তারা বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে অবস্থিত তাদের গ্যাসক্ষেত্রসমূহ থেকে সরে আসছে। আর এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্যপতন। কিন্তু বাংলাদেশে শেভরন তার সম্পদ হস্তান্তর–প্রক্রিয়ায় যে বিতর্ক জন্ম দিয়েছে তার কারণ হলো সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের অগোচরে করা হয় যদিও পিএসসি চুক্তি অনুযায়ী শেভরন কেবল পেট্রোবাংলার অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পদ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চালাতে পারে। অধিকন্তু শেভরন বাংলাদেশ কর্তৃক গ্যাসক্ষেত্রসমূহ নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর।
শেভরনের এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কার্যক্রমের সূত্র কোথায়? আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান লেখক অ্যান্থনি সিমসন তাঁর সেভেন সিস্টার্স নামক বেস্টসেলার বইটিতে যথার্থই লিখেছেন যে ১৯৪০-১৯৭০ সময়ে বিশ্বব্যাপী সাতটি বৃহৎ তেল কোম্পানি (এক্সন, শেভরন, শেল, বিপি, মোবিল, টেক্সাকো ও গাল্ফ) প্রচণ্ড প্রতাপে মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বে তেল আবিষ্কারের তাণ্ডবে রাতারাতি বহু দেশকে বিশাল সম্পদশালী করে তোলে, যার সঙ্গে এই সাতটি কোম্পানির সম্পদের সীমাও আকাশ ছুঁয়ে যায়। আর তার সঙ্গে বাড়ে তাদের দাপট ও ক্ষমতা। যে ক্ষমতা কেবল আর্থিক নহে, সামাজিক ও সামরিকও বটে, যা কিনা প্রতিফলিত হয় নানা রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাপ্রবাহে। তবে সেভেন সিস্টারসের সেই স্বর্ণযুগ আর নেই। বিশ্ব ইতিহাসের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট একজোট বাঁধা এই প্রতাপশালী সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে ভেঙে দিয়েছে। শেভরনকে বুঝতে হবে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ পূর্ণ মর্যাদাবান স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। অতীতের দাপট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দিয়ে বাংলাদেশে তার স্বার্থ সিদ্ধি হবে না। আর এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।