এ মাসের শুরুতে বিশ্বনেতারা গ্লাসগোতে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ ২৬) মিলিত হয়েছিলেন। তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। সম্মেলন চলাকালে আমাদের মতো আন্দোলনকর্মীরা দাবি জানিয়েছেন, কার্বন নিঃসরণ বিষয়ে সরকারগুলো যাতে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে এবং অক্রিয় অবস্থান থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সমাপ্তি অধিবেশনে একের পর এক মন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং সম্মিলিত কর্মপন্থা গ্রহণের দাবি জানান। সন্তানসন্ততি এবং ভবিষ্যতের মানবজাতি রক্ষার আহ্বান ছিল তাঁদের কণ্ঠে। মানবজাতির মঙ্গলচিন্তায় চিন্তিত হলেও আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ধনী দেশগুলো তাদের জীবনযাত্রার বর্তমান মান কমানোর কোনো আগ্রহ দেখায়নি। চীন ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্র দুটিও কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।
নিম্ন আয়ের দেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো এতে গভীরভাবে প্রতারিত বোধ করেছে। মালদ্বীপের পরিবেশমন্ত্রীর বক্তব্যে যেটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে মালদ্বীপ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে। এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের মানচিত্র থেকে দেশটির অস্তিত্ব মুছে যেতে পারে। দেশটির মন্ত্রী শানা আমিনাথ কপ ২৬ সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে উপস্থিত মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি পানির সীমানায় রেখে আমরা এখানে আরেকবার আলোচনায় মিলিত হয়েছি। যাদের হাতে বিকল্প আছে, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কত দ্রুত তারা কাজ শুরু করছে। ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পার্থক্য হচ্ছে আমাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড।’
সম্মেলনে ১৪০টির বেশি দেশ এ শতাব্দীর মাঝ নাগাদ কার্বন ও গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ও শোষণ সমান করা বা ‘নেট জিরো’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর বাইরে চীন ২০৬০ এবং ভারত ২০৭০ সাল নাগাদ এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সময়কাল নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্ষেত্রে দেশগুলো ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অবস্থান অস্পষ্ট। গ্লাসগোতে বড় বহুজাতিক থেকে শুরু করে স্থানীয় ছোট কোম্পানিগুলো কে কার আগে নেট জিরো প্রতিশ্রুতি দেবে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামে। বিশ্বের দুই হাজারটি বড় বহুজাতিকের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সম্মেলনের আগেই এ প্রতিশ্রুতি ঘোষণা দেয়।
এটা অনেক বড় ঘটনা বলে মনে হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি একেবারে অন্য রকম। প্রকৃতপক্ষে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ও কোম্পানি কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তারা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কৌশলপত্রে নিঃসরণ কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের যথাযথ পথরেখা অনুসরণ করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জলবায়ু কৌশলপত্র জনসংযোগ চর্চার বাইরে বেশি কিছু নয়। বহুজাতিক কোম্পানি শেল নেদারল্যান্ডসে ‘কার্বন নিরপেক্ষকরণ’ বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছে। বিজ্ঞাপনে তারা দাবি করেছে, ভোক্তারা পেট্রলপাম্প থেকে তেল কেনার সময় এক ইউরো সেন্ট বেশি খরচ করলেই কার্বন নিঃসরণে ভারসাম্য তারা আনতে পারবে।
এ ধরনের অসংগত দাবি শুধু শেল করছে না। জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো তাদের তেল ও গ্যাস বিপণনের জন্য কার্বন নিরপেক্ষকরণের এ ধরনের দাবি তুলছে। ‘কার্বন মার্কেট ওয়াচ’ নামে একটা অনুসন্ধানকারী সংস্থা সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখিয়েছে, সবুজায়নের নামে তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো এ রকম নির্লজ্জ দাবি সামনে আনছে।
আমার মনে হয়, এটা মধ্যযুগে চার্চ যে পাপ স্খালন করত, সেটারই আধুনিক সংস্করণ। কিন্তু এখানে পাপীদের বদলে দূষণকারীরা তাদের দোষের জন্য প্রতীকী টাকা দিচ্ছে, কিন্তু তাদের ধ্বংসাত্মক আচরণে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে না। এরই মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডাচ বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক সংস্থা শেলকে এই বিজ্ঞাপন সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরনের অসংগত দাবি শুধু শেল করছে না। জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো তাদের তেল ও গ্যাস বিপণনের জন্য কার্বন নিরপেক্ষকরণের এ ধরনের দাবি তুলছে। ‘কার্বন মার্কেট ওয়াচ’ নামে একটা অনুসন্ধানকারী সংস্থা সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখিয়েছে, সবুজায়নের নামে তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো এ রকম নির্লজ্জ দাবি সামনে আনছে।
যারা অভ্যস্ত নয়, তাদের কানে নেট জিরো শব্দটা জিরোর মতোই শোনাবে। নেট জিরো এমন ধারণা দেয় যে কার্বন নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধ হবে। কিন্তু এখানে শুভংকরের ফাঁকি রয়ে গেছে। নেট জিরো করার একটা প্রধান উপায় গাছ লাগানো। আমরা যদি গাছ রোপণ করে কার্বন নিরপেক্ষকরণ করতে চাই, তাহলে বিশ্বে চার বিলিয়ন একর নতুন বনভূমি সৃজন করতে হবে। এ পরিমাণ বনভূমি সৃজনের জন্য পাঁচটা ভারতের সমান ভূমি দরকার। অথবা পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি আছে, তার সবটাই প্রয়োজন। এটা করতে গেলে গণ-অনাহার, যেমন অনিবার্য আবার বিষয়টি অবাস্তব ও অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে কার্বন নিরপেক্ষকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে পৃথিবীর মতো আরেকটি পৃথিবী লাগবে।
এই ‘নেট জিরো’ ধারণাটি বাস্তবতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনকে যেসব দেশ সত্যিই গুরুত্ব দিচ্ছে, তারা তাদের পরিকল্পনায় কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ বন্ধ ও ১০ শতাংশ নিরপেক্ষকরণের কথা বলছে। কিন্তু অন্য দেশ ও জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো ৯০ শতাংশ নিরপেক্ষকরণ ও ১০ শতাংশ নিঃসরণ বন্ধের কথা বলছে।
আরও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণের প্রকৃত পরিমাণটা দেশগুলো জানাচ্ছে না। ওয়াশিংটন পোস্টের নতুন এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কার্বন নিঃসরণের প্রকৃত পরিমাণ দেশগুলো যে পরিমাণের কথা বলছে, তার চেয়ে বছরে ১৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন বেশি। এই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাতে গেলে ৩০০ কোটি গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে গেলে আমাদের অবশ্যই ‘নেট জিরো’ নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে।
খালেদ দিয়াব সাংবাদিক ও লেখক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ